পাঠক! বাংলা ভাষায় সুবৃহৎ বিশুদ্ধ ইসলামী সাইটে আপনাকে স্বাগতম। সহীহ কুরআন, সুন্নাহনির্ভর রেফারেন্স ও গবেষণাধর্মী প্রায় ২০০এর অধিক বিষয়ের অনন্য সমাহার। আমাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ও অনুদান দিয়ে সাহায্য করতে পড়ুন এখানে

কুরআন সুন্নাহর আলোকে শবে বরাত

ইসলামিক রেডিও
শবে বরাত শব্দটি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ব্যবহার করেননি, সাহাবীরা ব্যবহার করেননি, তাবেঈরা ব্যবহার করেননি। এটা প্রায় পাঁচশো বছর পর তৈরি হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে পরিভাষাটি ব্যবহার করেছেন সেটা হলো- লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান বা মধ্য শাবানের রাত।

শবে বরাত বলাটা নাজায়েজ না; কিন্তু লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান বলাটা সুন্নাত। কুরআন-হাদীসে কোথাও শবে বরাত শব্দটি পাবেন না, ঠিক যেমন কুরআন-হাদীসের কোথাও নামাজ, রোজা শব্দগুলো পাবেন না। আপনি পাবেন সালাত, সিয়াম। তাই বলে, নামাজ-রোজা কুরআন-হাদীসে নাই এজন্য এগুলো বললে নাজায়েজ হয়ে যাবে, এমন না। এগুলো পারিভাষিক শব্দ। নামাজ-রোজা এগুলো হলো ফারসি শব্দ।
আবার, কুরআন-হাদীসের কোথাও পীর শব্দটি নেই। পীর শব্দটি ফারসি শব্দ, এর সমার্থক আরবি শব্দ হলো শায়েখ। এই শায়েখ শব্দটিও কুরআন-হাদীসে নেই। তবে এটার কুরআনিক শব্দ হলো সোহবত-সাহেব।
ঠিক তেমনি কুরআন-হাদীসে শবে বরাত নেই, লাইলাতুল বরাতও নেই। এর জায়গায় আছে লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান
কিছু মানুষ মনে করেন নবীজি কিছু করেননি তাই সেটি বিদআত। না, নবীজী কিছু করেননি এই বলে সেটা বিদআত হবে না। নবীজি করেননি তাই সেটা সুন্নাত না; কিন্তু সেটাকে সুন্নাত মনে করাটা বিদআত।
আবার আরেক গ্রুপ আছেন যারা নবীজি করেননি কিন্তু সেটা জায়েজ। এই যে জায়েজ প্রমাণ করতে গিয়ে তারা নবীর সুন্নাতকে ছোটো বানিয়ে ফেলেন।
আপনারা খেয়াল করবেন, যদি কোনোকিছু জানতে পারেন যে সেটা রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সুন্নাত; হোক সেটা ফরজ সুন্নাত, ওয়াজিব সুন্নাত, মুস্তাহাব সুন্নাত যাই হোক না কেন তার বাইরে কিছু ঢুকতে দিবেন না। আপনি যদি মানতে না পারেন তাহলে বলবেন, ভাই, দুআ করবেন, যেন সুন্নাতটি মানতে পারি। কিন্তু, নবীজির সুন্নাতের বিপরীতে কোনো কিছুকে আনবেন না।
তারমানে প্রথমে আমরা যেটা বুঝলাম, শবে বরাত বা লাইলাতুল বরাত শব্দটি নবী, সাহাবী, তাবে, ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালিক, ইমাম শাফে, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (আল্লাহ সবার উপর রহম করুন) কেউ ব্যবহার করেননি, এটা অনেক পরে তৈরি হয়েছে।

দুই.
সুন্নাতের মধ্যে নিরাপত্তা। সুন্নাতের বাইরে যেটা সেটা বিদআত না হলেও সমস্যা তৈরি করে। যেমন শবে বরাত শব্দটি। আমরা যদি মধ্য শাবানের রজনী বলি তাহলে কোনো উত্তেজনা তৈরি করে না। কিন্তু যখনই আমরা বলবো শবে বরাত তখনই আমাদের মধ্যে একটা ধারণা তৈরি হবে, এটা বুঝি ভাগ্য রজনী।
শবে বরাত হলো গুনাহ মাফের রজনী। আরবীতে বারআত শব্দের অর্থ মুক্তি। আমরা বাংলায় অর্থটি পাল্টে বরাত বা ভাগ্য করে ফেলেছি।
বারআত মানে মুক্তি। আল্লাহ শবে বারআতের রাতে বান্দার গুনাহ মাফ করেন, এটা সত্যি। এটা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
কিন্তু এই রাত্রিতে আল্লাহ ভাগ্য লিখেন, এই কথাটি কোনো হাদীসে নেই, কুরআনের কোনো আয়াতে নেই; এই ব্যাপারে যতো হাদীস আছে সবগুলো জাল হাদীস, তাফসীরে যে দু-একটা কথা বলা হয়েছে, কোনো তাফসীরকারক সেটা সমর্থন করেননি।
সূরা আদ-দুখানের (৪৪) ৩-৪ নাম্বার আয়াতকে যেসব তাফসীরকারক শবে বরাতের আয়াত বলে সমর্থন করেননিঃ
- তাফসীর ইবনে কাসির।
- জামিউল বায়ান, তাবারী।
- আল-কাশশাফ, যামাখশরী।
- ফাতহুল কাদীর, শাওকানী।
- রূহুল মাআনী, আলুসী।
- তাফসীর-ই আশরাফী, আশরাফ আলী থানবী।
- মারেফুল কুরআন, মুফতী শফী।
(উপরিউক্ত তাফসীরগুলোতে সূরা আদ-দুখানের ৩-৪ আয়াতের তাফসীর দেখে নিবেন। তাফসীরকারক সূরা দুখানে উল্লিখিত রাতকে 'শবে কদর' বলেছেন।)
তাফসীর ইবনে কাসিরে আছে-
"ইকরিমাহ থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, বরকতময় রাত্রিটি শাবানের মধ্যম রজনী, এই মতটি একটি অসম্ভব ও অবাস্তব মত। কারণ, কুরআনে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা হয়েছে যে, এ রাতটি রামাদানের মধ্যে (অর্থাৎ, কদরের রাত)।" [ইবনে কাসীর, তাফসীরুল কুরআনিল আযীমঃ ৪/১৪০]।

তিন.
এখন জিজ্ঞেস করবেন, শবে বারআতের আমল কী? তিনটি বিষয় বলবো।
প্রথম বিষয় হলোঃ
শবে বারআত বা লাইলাতুন নিসফি মিন শাবানের রাত্রিতে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের গুনাহ মাফ করেন, এটা সহীহ হাদীস।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে তাঁর সৃষ্টির প্রতি দিকপাত করেন এবং মুশরিক এবং বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করেন। [সুনানে ইবনে মাজাহঃ ১৩৯০]
তারমানে এই রাত্রিতে আল্লাহ দুই শ্রেণীর মানুষ বাদে বাকিদেরকে ক্ষমা করেন। দুই শ্রেণী হলোঃ
ক. মুশরিক।
খ. বিদ্বেষ পোষণকারী।
তারমানে হলো শবে বারআত হলো কমন বোনাস। এই রাত্রিতে আপনি যদি ঘুমিয়ে থাকেন, জেগে থাকেন, কিন্তু আপনার কোনো শিরক নেই, মনে কোনো বিদ্বেষ নেই তাহলে আল্লাহ আপনাকে মাফ করে দিবেন (ইন শা আল্লাহ)। আপনার একাউন্টে বোনাসটি জমা হয়ে যাবে।
দ্বিতীয় বিষয়টি হলোঃ
এই রাতে আমরা আমল করবো কি-না?
আমল না করে ঘুমিয়ে থাকলেও আপনি বোনাস পাবেন। এই রাতে আমল করার ব্যাপারে কোনো সহীহ হাদীস পাওয়া যায় না, তবে কিছু যঈফ হাদীস পাওয়া যায়। যঈফ হাদীসের আলোকে তিনটি আমল পাওয়া যায়।
ক. কবর যিয়ারত। [সুনানে ইবনে মাজাহঃ ১৩৮৯]
খ. দুআ করা। [আল-জামে আস-সাগীরঃ ৩৯৫২]
গ. নামাজ পড়া। [সুনানে ইবনে মাজাহঃ ১৩৮৮]
তবে সবগুলো হাদীসই যঈফ। কিন্তু, যেহেতু এই রাতের ফযিলত সহীহ, সেহেতু কেউ যদি অন্যান্য রাতে তাহাজুদ পড়ে, এই রাতেও পড়ে, অন্যান্য রাতে দুআ করে, এই রাতেও করে, তাহলে এটাকে কিছু কিছু ইমাম মুস্তাহাব বা বৈধ বলেছেন। যেমনঃ ইমাম আল-আউযায়ী, ইমাম আশ-শাফেঈ।
আমরাও মনে করি, যদি কেউ এই রাতে ব্যক্তিগতভাবে (আবারো বলছি, ব্যক্তিগতভাবে) তাহাজ্জুদ পড়ে, আল্লাহর কাছে দুআ করে, তবে সেটা নাজায়েজ হবে না, বিদআতও হবে না।

কয়েকটি কারণে এগুলো নাজায়েজ বা বিদআত হবে নাঃ

সুন্নাত দ্বারা ফযিলত প্রমাণিত, এখানে যঈফ হাদীস দ্বারা আমল করলে বিদআত হবে না।
তাবেঈদের মধ্য থেকে কোনো কোনো তাবেঈ এই রাতে ইবাদাত করেছেন। যেমনঃ আবু আব্দুল্লাহ মাকহুল, খালিদ বিন মাদান, আবু আব্দুল্লাহ হিমসী, লুকমান ইবনু আমির (আল্লাহ সবার উপর রহম করুন)।
এই রাত্রিতে সমবেত হয়ে ইবাদাত করাকে সবাই বিদআত বলেছেন, মাকরূহ বলেছেন, এটা নিয়ে কোনো মতভেদ নাই। যেমনঃ প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ আল্লামা হাসান ইবনু আম্মার শুরুম্বুলালী (রাহি)।
তৃতীয় বিষয়টি হলোঃ
এই রাত্রিতে ভাগ্য লিখা হয় এই মর্মে যা আছে সবই জাল হাদীস। এমনকি শবে বারআতের পরদিন রোজা রাখার ফজিলতের ব্যাপারে যে দুটো হাদীস আছে সেগুলোও জাল হাদীস পর্যায়ের।
তবে আমরা হাদীসে পাই, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শাবান মাসে বেশি বেশি রোজা রাখতেন [সহীহ বুখারীঃ ১৯৬৯]। তাছাড়া রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রতি মাসে তিন দিন রোজা রাখতেন। দিনগুলো হলো- তেরো, চৌদ্দ, পনেরো তারিখ (হিজরী) [জামে আত-তিরমিজিঃ ৭৬১]।
তাহলে আপনারা যদি রোজা রাখতে চান, তাহলে এই তিন দিন অর্থাৎ তেরো, চৌদ্দ, পনেরো তারিখ রাখবেন (যারমধ্যে আপনার শবে বারআতও পড়ে যায়)।
এই রাতে আমরা যা করবো নাঃ
- আলাদাভাবে রুটি খাওয়া
- উৎসব করা
- বাতি জ্বালানো
- মসজিদে সমবেত হয়ে ইবাদাত করা।
এগুলো হলো বিদআত। ফিকহের সবগুলো কিতাবে এগুলোকে বিদআত, মাকরূহে তাহরীমি লিখা হয়েছে।
....
আমরা শেষ কথায় পৌঁছতে পারি। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আবু বকর, উমর, উসমান, আলী (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) কেউই এই রাত উপলক্ষ্যে মসজিদে সমবেত হয়ে আলাদা ইবাদাত করেননি।
এই রাতে দুআ করলে দুআ কবুল হবে এমন হাদীস আমরা শুনি। কিন্তু এটা যঈফ [জামে আত-তিরমিজিঃ ১৩৮৮]।
তবে সহীহ বুখারীর আরেকটি হাদীসে আমরা পাই, প্রতি রাতের এক-তৃতীয়াংশ বাকী থাকতে আল্লাহ আকাশে এসে ঘোষণা দেন- যে আমাকে ডাকবে, আমি তার ডাকে সাড়া দেবো, যে আমার কাছে চাইবে, আমি তাকে দেবো, যে আমার কাছে মাফ চাইবে, আমি তাকে মাফ করবো। [সহীহ বুখারীঃ ১১৪৫]
এই সুযোগ প্রতি রাতে। আমরা যদি প্রতি রাতে দুআ করি, তাহলে প্রতি রাতই আমাদের জন্য শবে বরাত হয়ে যায়। মুসলিমের জন্য প্রতি রাতই তো দুআ কবুলের রাত। তারমানে দুআ কবুলের রাত শুধু শবে বরাতই না।

শবে বরাতঃ আমল ও ফজিলত
-ডক্টর খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রাহিমাহুল্লাহ)
ওয়াজের লিংকঃ https://bit.ly/2XgnwOt

এরকম আরো লেখা পড়ুন-
আরো পড়ুনঃ তাওহীদের পরিচয়
আরো পড়ুনঃ আল্লাহর পরিচয়

একটি আবেদন


‘শান্তি ও মানবতার পথে’ শ্লোগানকে সামনে রেখে বাংলা ভাষায় অনলাইন রেডিও প্রতিষ্ঠাসহ মিডিয়ায় গবেষণা, প্রচার, দাওয়াহ প্রভৃতি কাজের আঞ্জাম দেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে ‘সালাম মিডিয়া’। এজন্য বাৎসরিক প্রায় পাঁচলক্ষাধিক টাকার প্রয়োজন। আপনাদের সহযোগিতাই আমাদের পথচলার পাথেয়। আপনি প্রবাসী হলে মাসে অন্তত দশ ডলার বা বাৎসরিক হিসেবে দশ হাজার করে নূন্যতম হারে হলেও আমাদের এই অগ্রযাত্রায় শরীক হোন। 


আমাদের রয়েছে পর্যাপ্ত দক্ষ জনবলশুধু নেই প্রয়োজনীয় অর্থবল। আপনার প্রতি এই আমাদের ছোট্ট আহবান। ০১৯২২৭৩০০০১ (তথ্য ও বিকাশ) বিস্তারিত পড়ুনঃ  আমাদের কথা
ছবিটি জুম করে দেখুন

No comments: