নিজেকে এবং অপরাপর মুসলিম তারুণ্য-কে খুব কাছ থেকে পাঠ করে যাচ্ছি বছর খানেক ধরে। জীবনদর্শনের নানা চোরাবালিতে নিমজ্জনের দৃশ্য যখন থেকে চোখে পড়েছে, বৈষয়িক ধাঁধায় বাঁধা পড়া জীবনবোধের আর্তি যখন থেকে কানে আসতে শুরু করেছে, তখন থেকে ভাবা শুরু করেছি নিজেকে নিয়ে,
আশেপাশের মানুষগুলোকে নিয়ে। একটা ঝঞ্ছা-বিক্ষুব্ধ সময়ের পাটাতনে দাঁড়িয়ে আমি উচ্চারণ করেছি:
"কোন আলো নেই, কেউ ভালো নেই
বাতাসও এখন অস্থির
ঝড়ো রাত শেষে বলো কোথা এসে
নিঃশ্বাস নেবো স্বস্তির?"
এই প্রশ্নের উত্তর এক সময় আমি খুঁজেও পেয়েছি। কেউ এসে বলে দেয় নি, তবে জীবনের বাস্তব উপলব্ধির দরোজায় কুরআন-কে কড়া নাড়তে শুনেছি। নাগালের ভেতরে পাওয়া বন্ধু কিংবা ভাইগুলোকে বোঝাতে চেষ্টা করেছি, আল্লাহর স্মরণ ও আল্লাহর শরণেই স্বস্তি।
সমসাময়িক তরুণদের জীবনাচারের কাছাকাছি গেলে, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির সমীকরণ মেলাতে গিয়ে হিমশিম খাওয়া মানুষের সাথে কথা বললে আমার উপলব্ধি আরো বেশি পোক্ত হয়ে আসে। একটা উদাহরণ দেই। মানুষ তার কষ্টের সময় চায়, কেউ তার পাশে সমবেদনা নিয়ে পাশে আসুক। ভেঙ্গে পড়ার মুহূর্তে তার ইচ্ছে করে, ব্যথার জমাট বরফটা সে কাউকে দেখাক, কারো সহানুভূতির উষ্ণতায় বরফটা গলে যাক। কিন্তু বাস্তবতা হল, মানুষ মানুষের ভার বহন করতে অক্ষম। কদাচিৎ সহমর্মিতার ঝলক নিয়ে সে আসবে বটে, কিন্তু পলক পড়তে না পড়তেই সহমর্মী মানুষটা নিজেই 'অলকের পাথার' বেয়ে অদৃশ্য হবে। অথবা অদৃশ্য না হলেও সহমর্মিতার পারদ আপনা থেকেই নিম্নগামী হতে শুরু করবে। এটাই মানবপ্রকৃতি।
খ্যাতিমান ব্রিটিশ গীতিকার মাইকেল ব্যার্যাট। একদিন তার লেখা লিরিকগুলোতে চোখ বুলাচ্ছিলাম। আমার উপলব্ধি প্রতিধ্বনিত হতে দেখলাম তার ভাবনার দেয়ালেও:
Don't tell me your troubles
I got troubles of my own
Don' t tell me your troubles
Leave me alone.
এটাকে কাব্যানুবাদ করার চেষ্টা করলাম-
"তোমার কষ্ট আমাকে শোনাতে আসবে না আর
আমার নিজের কষ্টগুলোই বাড়াচ্ছে ভার
আমাকে তোমার কষ্ট শোনাতে এসো না, যাও!
আমাকে এবার একটু একাকী থাকতে দাও।"
কী বোঝা গেলো? এই কাব্যের কথক এক সময় কারো ব্যথায় সমব্যথী হয়েছিলেন। কেউ তার বেদনার ঝুলি নিয়ে তার কাছে আসতো, সেই ঝুলি থেকে কিছু বেদনা তিনি নিজ কাঁধে নিয়ে নিতেন। কিন্তু এখন তিনি আর পারছেন না। নিজের যাপিত জীবন ব্যথাতুর হয়ে আছে যেখানে, সেখানে আরেকটি জীবনের ব্যথা নিয়ে মাথাব্যথার সুযোগ নেই তাঁর।
অসহায় মুহূর্তে কাউকে সহায় হিসেবে পাওয়ার জন্যে মানুষের ব্যাকুলতা স্বাভাবিক, একইসাথে প্রাকৃতিকও। সীমাবদ্ধতার শেষ প্রান্তে এসে সহমর্মী মানুষ ক্লান্ত হলেও সহমর্মিতা-প্রত্যাশী মানুষের প্রয়োজনবোধ ক্লান্ত হয় না। কিন্তু এই প্রত্যাশা যখন সে প্রকাশ করে, তখন অনিবার্যভাবেই তাকে শুনতে হয় "Don't tell me your troubles / I got troubles of my own..."
জীবনের রূঢ বাস্তবতা এটাই। মানুষ সত্তাগতভাবেই এই সীমাবদ্ধতা নিয়ে পৃথিবীতে আসে। তার জীবনটা সীমাবদ্ধ। তার জানার পরিধিও অসীম নয়। তেমনি তার সহমর্মিতা-সহানুভূতিও একটা বিশেষ পর্যায় পর্যন্ত গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়তে বাধ্য হয়।
কিন্তু একজন আল্লাহতে বিশ্বাসী মানুষ যখন ব্যথাতুর হন, তখন তিনি এমন এক সত্তার কাছে তাঁর আর্তি ও আর্জি পেশ করতে পারেন, যিনি সীমাবদ্ধতার উর্ধ্বে, যিনি ক্লান্তি ও শ্রান্তির নাগালের বাইরে। তাঁকে ডাকলে তিনি সাড়া দেন, তাঁর কাছে হাত তুললে তিনি ভরে দেন, তাঁর কাছে ভাঙ্গা বুক নিয়ে এলে তিনি সারিয়ে দেন। প্রয়োজন শুধু একান্তে একটু ডাকা, শুধু আস্থা ও ভরসার পুরো নিবেদন সহযোগে তাঁর কাছে সমর্পিত হওয়া।
আল্লাহর একজন নাবী ইয়াকূব (عليه السلام)।
তিনিও কাউকে তাঁর হৃদয়ের আকুতি পেশ করার তাড়না অনুভব করেছিলেন।
কোনো সত্তাকে তাঁর অনুযোগ পেশ করার জন্যে, কোনো ভরসার আশ্রয়স্থল খোঁজার জন্যে তিনি প্রাণিত হয়েছিলেন।
ফলাফল কী?
তাঁর জবানিতে কুরআনের সাক্ষ্য:
وَلَمْ أَكُنْ بِدُعَائِكَ رَبِّ شَقِيًّا
"আমার রব্ব! আমি তো তোমাকে ডেকে কখনো হতাশ হই নি!" [১৯:০৪]
এবার ব্যারেটের কবিতাটা আরেকবার স্মরণ করুন। সেই কবিতায় আমরা দুইটি হতাশ মুখচ্ছবির প্রতিবিম্ব দেখতে পাই। অনুযোগকারীও নিরাশ, অনুযোগের আশ্রয়ও আশাহীন। কিন্তু আমাদের দ্বিতীয় গল্প পুরোপুরি ব্যতিক্রম। যিনি অনুযোগ পেশ করছেন, তিনি শেষ পর্যন্ত আশার আলোয় উদ্দীপ্ত, যাঁর কাছে অনুযোগ পেশ করা হচ্ছে, তাঁর নির্ভরতাও অক্লান্তভাবেই করুণার ছায়া বিলানোয় সন্দ্বীপ্ত।
আমি বারবার তাঁর কাছে ফিরে আসি তাই।
আমার আস্থা স্থায়ীত্ব পায় শুধু তাঁর স্মরণেই।
আমার নির্ভরতা নির্ভার হয় শুধু তাঁর শরণেই।
আমার তাই খুব প্রয়োজন আমার রব্ব-কে।
লিখেছেনঃ আব্দুল্লাহ মাহমুদ নজীব
আরো পড়ুনঃ ধর্ম, সংস্কৃতি ও ইসলাম
আরো পড়ুনঃ আল্লাহ সুব. অস্তিত্বের একটি বুদ্ধিবৃত্তিক প্রমাণ
আরো পড়ুনঃ বিদআতের পরিচয়, পরিণতি ও ভয়াবহতা
আরো পড়ুনঃ জান্নাত পাওয়ার সত্তরটি আমল ও বৈশিষ্ট্য
আশেপাশের মানুষগুলোকে নিয়ে। একটা ঝঞ্ছা-বিক্ষুব্ধ সময়ের পাটাতনে দাঁড়িয়ে আমি উচ্চারণ করেছি:
"কোন আলো নেই, কেউ ভালো নেই
বাতাসও এখন অস্থির
ঝড়ো রাত শেষে বলো কোথা এসে
নিঃশ্বাস নেবো স্বস্তির?"
এই প্রশ্নের উত্তর এক সময় আমি খুঁজেও পেয়েছি। কেউ এসে বলে দেয় নি, তবে জীবনের বাস্তব উপলব্ধির দরোজায় কুরআন-কে কড়া নাড়তে শুনেছি। নাগালের ভেতরে পাওয়া বন্ধু কিংবা ভাইগুলোকে বোঝাতে চেষ্টা করেছি, আল্লাহর স্মরণ ও আল্লাহর শরণেই স্বস্তি।
সমসাময়িক তরুণদের জীবনাচারের কাছাকাছি গেলে, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির সমীকরণ মেলাতে গিয়ে হিমশিম খাওয়া মানুষের সাথে কথা বললে আমার উপলব্ধি আরো বেশি পোক্ত হয়ে আসে। একটা উদাহরণ দেই। মানুষ তার কষ্টের সময় চায়, কেউ তার পাশে সমবেদনা নিয়ে পাশে আসুক। ভেঙ্গে পড়ার মুহূর্তে তার ইচ্ছে করে, ব্যথার জমাট বরফটা সে কাউকে দেখাক, কারো সহানুভূতির উষ্ণতায় বরফটা গলে যাক। কিন্তু বাস্তবতা হল, মানুষ মানুষের ভার বহন করতে অক্ষম। কদাচিৎ সহমর্মিতার ঝলক নিয়ে সে আসবে বটে, কিন্তু পলক পড়তে না পড়তেই সহমর্মী মানুষটা নিজেই 'অলকের পাথার' বেয়ে অদৃশ্য হবে। অথবা অদৃশ্য না হলেও সহমর্মিতার পারদ আপনা থেকেই নিম্নগামী হতে শুরু করবে। এটাই মানবপ্রকৃতি।
খ্যাতিমান ব্রিটিশ গীতিকার মাইকেল ব্যার্যাট। একদিন তার লেখা লিরিকগুলোতে চোখ বুলাচ্ছিলাম। আমার উপলব্ধি প্রতিধ্বনিত হতে দেখলাম তার ভাবনার দেয়ালেও:
Don't tell me your troubles
I got troubles of my own
Don' t tell me your troubles
Leave me alone.
এটাকে কাব্যানুবাদ করার চেষ্টা করলাম-
"তোমার কষ্ট আমাকে শোনাতে আসবে না আর
আমার নিজের কষ্টগুলোই বাড়াচ্ছে ভার
আমাকে তোমার কষ্ট শোনাতে এসো না, যাও!
আমাকে এবার একটু একাকী থাকতে দাও।"
কী বোঝা গেলো? এই কাব্যের কথক এক সময় কারো ব্যথায় সমব্যথী হয়েছিলেন। কেউ তার বেদনার ঝুলি নিয়ে তার কাছে আসতো, সেই ঝুলি থেকে কিছু বেদনা তিনি নিজ কাঁধে নিয়ে নিতেন। কিন্তু এখন তিনি আর পারছেন না। নিজের যাপিত জীবন ব্যথাতুর হয়ে আছে যেখানে, সেখানে আরেকটি জীবনের ব্যথা নিয়ে মাথাব্যথার সুযোগ নেই তাঁর।
অসহায় মুহূর্তে কাউকে সহায় হিসেবে পাওয়ার জন্যে মানুষের ব্যাকুলতা স্বাভাবিক, একইসাথে প্রাকৃতিকও। সীমাবদ্ধতার শেষ প্রান্তে এসে সহমর্মী মানুষ ক্লান্ত হলেও সহমর্মিতা-প্রত্যাশী মানুষের প্রয়োজনবোধ ক্লান্ত হয় না। কিন্তু এই প্রত্যাশা যখন সে প্রকাশ করে, তখন অনিবার্যভাবেই তাকে শুনতে হয় "Don't tell me your troubles / I got troubles of my own..."
জীবনের রূঢ বাস্তবতা এটাই। মানুষ সত্তাগতভাবেই এই সীমাবদ্ধতা নিয়ে পৃথিবীতে আসে। তার জীবনটা সীমাবদ্ধ। তার জানার পরিধিও অসীম নয়। তেমনি তার সহমর্মিতা-সহানুভূতিও একটা বিশেষ পর্যায় পর্যন্ত গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়তে বাধ্য হয়।
কিন্তু একজন আল্লাহতে বিশ্বাসী মানুষ যখন ব্যথাতুর হন, তখন তিনি এমন এক সত্তার কাছে তাঁর আর্তি ও আর্জি পেশ করতে পারেন, যিনি সীমাবদ্ধতার উর্ধ্বে, যিনি ক্লান্তি ও শ্রান্তির নাগালের বাইরে। তাঁকে ডাকলে তিনি সাড়া দেন, তাঁর কাছে হাত তুললে তিনি ভরে দেন, তাঁর কাছে ভাঙ্গা বুক নিয়ে এলে তিনি সারিয়ে দেন। প্রয়োজন শুধু একান্তে একটু ডাকা, শুধু আস্থা ও ভরসার পুরো নিবেদন সহযোগে তাঁর কাছে সমর্পিত হওয়া।
আল্লাহর একজন নাবী ইয়াকূব (عليه السلام)।
তিনিও কাউকে তাঁর হৃদয়ের আকুতি পেশ করার তাড়না অনুভব করেছিলেন।
কোনো সত্তাকে তাঁর অনুযোগ পেশ করার জন্যে, কোনো ভরসার আশ্রয়স্থল খোঁজার জন্যে তিনি প্রাণিত হয়েছিলেন।
ফলাফল কী?
তাঁর জবানিতে কুরআনের সাক্ষ্য:
وَلَمْ أَكُنْ بِدُعَائِكَ رَبِّ شَقِيًّا
"আমার রব্ব! আমি তো তোমাকে ডেকে কখনো হতাশ হই নি!" [১৯:০৪]
এবার ব্যারেটের কবিতাটা আরেকবার স্মরণ করুন। সেই কবিতায় আমরা দুইটি হতাশ মুখচ্ছবির প্রতিবিম্ব দেখতে পাই। অনুযোগকারীও নিরাশ, অনুযোগের আশ্রয়ও আশাহীন। কিন্তু আমাদের দ্বিতীয় গল্প পুরোপুরি ব্যতিক্রম। যিনি অনুযোগ পেশ করছেন, তিনি শেষ পর্যন্ত আশার আলোয় উদ্দীপ্ত, যাঁর কাছে অনুযোগ পেশ করা হচ্ছে, তাঁর নির্ভরতাও অক্লান্তভাবেই করুণার ছায়া বিলানোয় সন্দ্বীপ্ত।
আমি বারবার তাঁর কাছে ফিরে আসি তাই।
আমার আস্থা স্থায়ীত্ব পায় শুধু তাঁর স্মরণেই।
আমার নির্ভরতা নির্ভার হয় শুধু তাঁর শরণেই।
আমার তাই খুব প্রয়োজন আমার রব্ব-কে।
লিখেছেনঃ আব্দুল্লাহ মাহমুদ নজীব
আরো পড়ুনঃ ধর্ম, সংস্কৃতি ও ইসলাম
আরো পড়ুনঃ আল্লাহ সুব. অস্তিত্বের একটি বুদ্ধিবৃত্তিক প্রমাণ
আরো পড়ুনঃ বিদআতের পরিচয়, পরিণতি ও ভয়াবহতা
আরো পড়ুনঃ জান্নাত পাওয়ার সত্তরটি আমল ও বৈশিষ্ট্য
ছবিটি জুম করে দেখুন |