পাঠক! বাংলা ভাষায় সুবৃহৎ বিশুদ্ধ ইসলামী সাইটে আপনাকে স্বাগতম। সহীহ কুরআন, সুন্নাহনির্ভর রেফারেন্স ও গবেষণাধর্মী প্রায় ২০০এর অধিক বিষয়ের অনন্য সমাহার। আমাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ও অনুদান দিয়ে সাহায্য করতে পড়ুন এখানে

বিদআতের পরিচয়, পরিণতি ও ভয়াবহতা

বিদআতের সংজ্ঞা
       বিদআত শব্দের শাব্দিক অর্থ নব উদ্ভাবন। প্রখ্যাত ভাষাবিদ ইবনু মানযুর লিখেন : ‘‘বিদআত অর্থ : নতুন সৃষ্ট এবং দীনের পূর্ণতার পর যা উদ্ভাবন করা হয়েছে’’[1] দ্বিতীয় অর্থটি মূলত পারিভাষিক। ইবনু ফারিস[2] বিদআতের অর্থ লিখেন : পূর্ব নমুনা ব্যতিরেকে কোনো কিছু সৃষ্টি করা, শুরু করা বা প্রচলন করা।[3]
 
  লিসানুল আরব অভিধান থেকে আমরা শাব্দিক অর্থের সাথে সাথে বিদআতের পরিভাষিক অর্থ জানতে পেরেছি। আরেকটু স্পষ্ট হওয়ার জন্য ফিক্বহী পরিভাষায় বিদআতের যে সংজ্ঞা দেওয়া হয় তা উল্লেখ করা হল :

"البدعة طريقة في الدين مخترعة تضاهي الشرعية يقصد بالسلوك عليها ما يقصد بالطريقة الشرعية".(الاعتصام، الباب الأول في تعريف البدع وبيان معناها...،1-26)
‘‘বিদআত হচ্ছেদীনের মধ্যে আবিষ্কৃত পদ্ধতিযা শরয়ী পদ্ধতির সামঞ্জস্যএই পদ্ধতির উপর চলার সেই উদ্দেশ্য যা শরয়ী পদ্ধতির উপর চলার উদ্দেশ্য’’[4]
       কেউ কেউ বলেন :
‘‘দীনের মধ্যে আবিষ্কৃত পদ্ধতিযা শরয়ী পদ্ধতির সামঞ্জস্যএই পদ্ধতির উপর চলার উদ্দেশ্য হলো : আল্লাহ সুব্হানাহুর ইবাদতের মধ্যে বৃদ্ধি করা।’’[5]
       শরয়ী পদ্ধতি বলতে ইবাদতের সুন্নাত পদ্ধতি বুঝানো হয়েছে। কেননা সুন্নাত পদ্ধতি বা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবাদত জাতীয় যে বিষয়ে তিনি যে পদ্ধতি উম্মতকে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন তাই শরয়ী পদ্ধতি। এর বাইরে কোনো শরয়ী পদ্ধতি নেই। এই অর্থেই আহলুস্সুন্নাহ শব্দের বিপরীতে আহলুল বিদআহ শব্দটি উলামায়ে কেরাম প্রয়োগ করে থাকেন বলে আমরা ইতোপূর্বে দেখে এসেছি।
      বিভিন্ন হাদীসে বিদআত বা নব উদ্ভাবিত বিষয় বুঝাতে মুহ্দাসাত’ শব্দটিও ব্যবহার করা হয়েছেযা একটু পরেই আমরা দেখতে পাব ইনশাআল্লাহ। বিদআত বা মুহদাসাতের শরয়ী সংজ্ঞা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যেশরীয়তের পরিভাষায় বিদআত শুধুমাত্র ইবাদত কেন্দ্রিক বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত হবে। যে কোনো নব অবিস্কৃত জিনিসের উপর শাব্দিক অর্থে বিদআতের প্রয়োগ করা গেলেও শরয়ী অর্থে তার উপর বিদআত শব্দ প্রয়োগ হবে না এবং তা বিদআত  মুহদাসাত সংক্রান্ত হাদীসের আওতাধীন হবে না। যেমন ধরুননবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উটে সওয়ার হয়ে সফর করেছেনযানবাহনের আবিষ্কার আজ আপনাকে বিমান আরোহন করাচ্ছেআপনি বিমান আরোহন করে সফর করছেন। বিমান নব আবিষ্কার। উটের পরিবর্তে আপনি বিমান আরোহন করছেন। এটাকে শরয়ী বিদআত বলা যাবে না। কেননা উট বিমান কোনোটি ইবাদত নয়। এটি একটি বাহন মাত্র। তবে বাহনে সওয়ার হতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে দো পড়তেনতিনি সফরের যে দো পড়তেন তা ইবাদত। এই দোআর মধ্যে কোনো সংযোজন বা বিয়োজন করার সুযোগ নেই। এই দো তিনি যে পদ্ধতিতে পড়তেন আমাকেও সেই পদ্ধতিতেই পড়তে হবে। যুক্তির আলোকে এখানে কোনো পরিবর্তন ঘটানো যাবে না। যেমনউট একটি সাধারণ জন্তুসে মাটিতে চলেনবীজী উটে উঠতে এই দো পড়তেন। আমি আজ আকাশে চড়ছিএই নেয়ামত অনেক বড়সুতরাং দোআকে একটু বৃদ্ধি করতে হবে। অথবা নবীজী স্বাভাবিকভাবে দো পড়তেনকেননা নেয়ামতটি স্বাভাবিক ছিলকিন্তু আমার নেয়ামতটি অসাধারণতাই বিমানে উঠেই সেজদায় পড়ে এই দো করতে হবেঅথবা সেজদায় পড়ে দোআটি পড়লে ছওয়াব বেশি হবেএজাতীয় চিন্তাধারা সবই ভ্রান্ত কেননা দো একটি ইবাদত। আর ইবাদতের ক্ষেত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পদ্ধতির বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। গেলেই তা বিদআত বলে গণ্য হবে। মোটকথা : বিদআতের সম্পর্ক ইবাদতের বিষয়  তার পদ্ধতির সাথে। বস্তুর সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
       জনৈক ব্যক্তি একবার এক বিদআত বিরোধী আলেমকে গিয়ে বললেন : আপনারা সবকিছুই শুধু বিদআত বিদআত করেনতবে আপনি চশমা পরেছেন কেনআল্লাহর রাসূল কি জীবনে কখনো চশমা পরেছেনচশমা তো নবীজীর সময়ে ছিল নাতাহলে এটা কি বিদআত নয়আলেম বললেন : ভাইতাহলে তো আপনি নিজেই বিদআত। আপনিও তো নবীজীর সময়ে ছিলেন না। বিদআত না বোঝার কারণেই মাঝে মাঝে এমন কৌতুকের সৃষ্টি হয়। চশমা কোনো ইবাদত নয়। তাই এর সাথে বিদআতের কোনো সম্পর্ক নেই। যেমন লোকটি নিজে কোনো ইবাদত নয়তাই সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময় না থাকাআবার এখন থাকা বিদআতের বিষয় নয়। যে ইবাদত বা তার পদ্ধতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক প্রমাণিত নয় একমাত্র তার আবিষ্কার শরয়ী পরিভাষায় বিদআত বলে গণ্য হবে

বিদআতের পরিণাম
       বিদআত মানেই ক্রমান্বয়ে দীনের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যাওয়া। কেননা দীন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক অনুমোদিত জীবন পদ্ধতির নাম।  তাঁর পদ্ধতি থেকে বিভিন্ন যুক্তির আলোকে যে ব্যক্তি বেরিয়ে পড়েসে মূলত দীন থেকেই বেরিয়ে পড়ে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পদ্ধতি থেকে যে যতটুকু বের হয়সে মূলত ততটুকু দীন থেকে বের হয়। তাই এব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে পূর্ব থেকে সতর্ক করে গেছেনযাতে করে যুক্তির আলোকে কেউ তাঁর দেখানো আদর্শ  পদ্ধতি থেকে সরে না যায়। ইরবায ইবন সারিয়া আসসুলামি রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিততিনি বলেন :
" وعظنا رسول الله صلى الله عليه و سلم يوما بعد صلاة الغداة موعظة بليغة ذرفت منها العيون ووجلت منها القلوب فقال رجل : إن هذه موعظة مودع فماذا تعهد إلينا يا رسول الله ؟ قال : أوصيكم بتقوى الله والسمع والطاعة وإن عبد حبشي فإنه من يعش منكم يرى اختلافا كثيرا وإياكم ومحدثات الأمور فإنها ضلالة فمن أدرك ذلك منكم فعليه بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين المهديين عضوا عليها بالنواجذ ". (سنن الترمذي، كتاب العلم عن رسول الله، باب ما جاء في الاخذ بالسنة واجتناب البدعة، رقم:2676)
‘‘একদিন ফজরের সালাতের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী নসীহত করলেনএতে সবার চোখে অশ্রু বয়ে গেলহৃদয়গুলো ভীত শঙ্কিত হলো। এক লোক বলে উঠল : নিশ্চয় এটি বিদায়ী নসীহতঅতএব আপনি আমাদের থেকে কী অঙ্গিকার নিবেন হে আল্লাহর রাসূলরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : আমি তোমাদেরকে আল্লাহভীতি অর্জনের ওসিয়্যত (অঙ্গিকারগুরুত্বপূর্ণ উপদেশকরছিনেতার কথা মান্য  তাঁর আনুগত্যের নির্দেশ দিচ্ছিযদিও সে হাবশী দাস হয়। কেননা তোমাদের মধ্যে যে জীবিত থাকবে সে অনেক মতবিরোধ দেখতে পাবে। আর তোমরা সব নব অবিস্কৃত বিষয় থেকে বেঁচে থাকবেকেননা এগুলো পথভ্রষ্টতা। তোমাদের মধ্যে যে এই অবস্থা পাবে সে যেন আমার সুন্নাত এবং খুলাফায়ে রাশিদিনের সুন্নাত আকড়ে ধরে। তোমরা সুন্নাতকে মাড়ির দাঁত দিয়ে আকড়ে ধর।’’[6]
       বিদআত কাকে বলে বুঝতে এবং তা থেকে সতর্ক থাকতে সুন্নাত প্রেমিকদের জন্য এই একটি হাদীসই যথেষ্ট। আল্লাহর রহমতে সর্বদা একদল এর উপর ছিলেন বলেই সুন্নাত সংরক্ষিত হয়ে আমাদের পর্যন্ত পৌছেছে। জান্নাতে পৌঁছতেতাযকিয়ার চূড়ান্তে উপনীত হতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাতই আমাদের জন্য যথেষ্ট। সুন্নাতের বাইরে কোনো কিছুকে যে কোনো ক্ষেত্রে মনে স্থান দেওয়া মানেই গোমরাহীর পথ খুলে দেওয়াযা উপরোক্ত হাদীসে স্পষ্ট। এভাবে বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দীনের মধ্যে পরিবর্তন পরিবর্ধন করার কঠিন পরিণতি সম্পর্কে আমাদেরকে সংবাদ দিয়েছেন।
সাহল ইবনে সাআবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত একটি হাদীস দেখুননবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
" إني فرطكم على الحوض من مر علي شرب ومن شرب لم يظمأ أبدا ليردن علي أقوام أعرفهم ويعرفونني ثم يحال بيني وبينهم، فأقول إنهم مني فيقال إنك لا تدري ما أحدثوا بعدك فأقول سحقا سحقا لمن غير بعدي ". (صحيح البخاري،كتاب الرقاق، باب في الحوض، رقم:6212، كتاب الفتن، باب ما جاء في قول الله تعالى { واتقوا فتنة..., رقم:6643)
‘‘আমি তোমাদের আগে হাওযে গিয়ে তোমাদের জন্য অপেক্ষা করব। যে আমার কাছে যাবে সে (হাউয থেকেপান করবেআর যে পান করবে সে কখনো পিপাসার্ত হবে না। অনেক মানুষ আমার কাছে (হাওযে পানি পানের জন্যআসবেযাদেরকে আমি চিনবতারাও আমাকে চিনবেতবে তাদের এবং আমার মাঝে বাঁধা সৃষ্টি করা হবে, (আমার কাছে আসতে দেওয়া হবে নাআমি বলব এরা আমার উম্মত। তখন (প্রতি উত্তরেবলা হবে : আপনি জানেন নাএরা আপনার পরে কী সব নব উদ্ভাবন করেছিল। একথা শুনে আমি বলব : যারা আমার পর পরিবর্তন করেছেন তারা দূর হয়ে যাকতারা দূর হয়ে যাক!’’[7]
ইবাদতের যে কোনো নবআবিষ্কৃত পদ্ধতি বিদআত এতে জড়িত হওয়ার কী রুণ পরিণতি তা আমরা লক্ষ্য করতে পেরেছি। তেলাওয়াতযিকরদোদুরূদ ইত্যাদির নতুন পদ্ধতি আবিস্কারের কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে তাড়িয়ে দিলে আমাদের মত হতভাগা আর কে আছেআরো লক্ষ্যণীয় যেনবীজী সবচেয়ে বেশি যে জিনিস থেকে বারণ করতেন তা হচ্ছে বিদআত সর্বদা বারণের কারণ আশাকরি স্পষ্ট হয়েছে।
এবার নবীজীর খুতবার সিফাত বর্ণনার হাদীসটি দেখি:
  " كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول في خطبته : يحمد الله ويثني عليه بما هو له أهل ثم يقول : من يهد الله فلا مضل له و من يضلل فلا هادي له إن أصدق الحديث كتاب الله و أحسن الهدى هدى محمد و شر الأمور محدثاتها و كل محدثة بدعة و كل بدعة ضلالة و كل ضلالة في النار". (صحيح ابن خزيمة، باب صفة خطبة النبي، رقم: 1785)
‘‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর খুতবায় প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা  তার যথাযথ গুণাবলী বর্ণনা করতেনএরপর বলতেনযাকে আল্লাহ হেদায়াত প্রদান করেন তাকে কেউ গোমরাহ করতে পারে নাআর যাকে আল্লাহ গোমরাহ করেন তাকে কেউ হেদায়াত প্রদান করতে পারে না। নিশ্চয় সর্বাধিক সত্য কথা আল্লাহর কিতাব এবং সর্বাধিক সুন্দর আদর্শ মুহাম্মদের আদর্শনব উদ্ভাবিত বিষয় সর্বাধিক নিকৃষ্টপ্রত্যেক নব উদ্ভাবিত বিষয় বিদআতপ্রত্যেক বিদআত ভ্রষ্টতা এবং এবং প্রত্যেক ভ্রষ্টতা জাহান্নামে নিক্ষেপ্ত।’’[8]
উপরোক্ত হাদীসটির দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জীবনে আমাদের যত কথা বলে গেছেন সবই হাদীস। তিনি যা বলেছেনযা করতে নির্দেশ দিয়েছেন তা কতবার বলেছেননিশ্চয় একবারদুইবারতিনবারএকাধিক বারক্ষেত্র বিশেষে অনেক বার। কিন্তু উপরোক্ত হাদীসে বর্ণিত কথাগুলো তিনি কতবার বলেছেননবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  তাঁর জীবনে কতটি খুতবা দিয়েছেনএকটিদুইটিএকাধিকঅনেকঅগণিতযতবারই তিনি খুতবা দিয়েছেনউপরের বিষয়গুলো আলোচনা করতেন বলে আমরা জানতে পারলাম। এখান থেকে একটি ধারণা নেই যেরাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনে কতবার বলেছেন‘‘একমাত্র আদর্শ তাঁরই আদর্শতাঁর আদর্শের বাইরের সবকিছুই নব উদ্ভাবিতসব নব উদ্ভাবিত কর্ম বিদআতসব বিদআতই গোমরাহী এবং প্রত্যেক ভ্রষ্টতা জাহান্নামে নিক্ষেপ্ত।’’ এছাড়া অন্যান্য হাদীসতো আছেই। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শ বহির্ভূত কোনো আমল গ্রহণযোগ্য নয়চাই তা যে কোনো উদ্দেশ্যেই হোক না কেন।
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত হাদীসটি দেখুন:
قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : "من أحدث في أمرنا هذا ما ليس فيه فهو رد". (صحيح البخاري، كتاب الصلح، باب إذا اصطلحوا على صلح جور فالصلح مردود، رقم: 2550، صحيح مسلم، كتاب الأقضية، باب نقض الأحكام الباطلة ورد محدثات الأمور، رقم: 4589)
‘‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনআমাদের এই দীনে যে ব্যক্তি নতুন কিছু উদ্ভাবন করবে তা প্রত্যাখ্যাত।’’[9]
       এই হলো বিদআতের অবস্থা। আমলের ক্ষেত্রে সুন্নাতের বিপরীত চিন্তা মানেই বিদআতে লিপ্ত হওয়ার প্রক্রিয়াআর বিদআত মানেই দীন ধ্বংসের প্রক্রিয়া। তাই সাহাবায়ে কেরাম  কল্যাণপ্রাপ্ত যুগ তথা খাইরুল ক্বুরুনের আলেমদেরকে এব্যাপারে সর্বাধিক সতর্ক থাকতে দেখা গেছে। বিদআত দূরের কথাবিদআতের সন্দেহযুক্ত বিষয়কেও তারা প্রত্যাখ্যান করে চলেছেন।  ব্যাপারে ইমাম আবু হানিফা রাহ.কে এতই সতর্ক থাকতে দেখা যায় যেপ্রমাণিত সুন্নাতের মাঝেও সমান্যতম হেরফের হলেই তিনি তা বিদআত বলে আখ্যায়িত করতেন এবং  থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিতেন। ফিক্বহে হানাফিতে বিদ্যমান অসংখ্য মাসআলা এর জলন্ত প্রমাণ। এথেকেই হানাফী মাযহাবের সিদ্ধান্ত হলোকোনো বিষয় সুন্নাত  বিদআতের মাঝে সংশয়যুক্ত হলে তা বিদআত বলে গণ্য করে পরিহার করতে হবে। কারণ কাজটি যদি বাস্তবেই সুন্নাত হয়ে থাকে তবে ছেড়ে দিলে গোনাহ্গার হবে নাশুধুমাত্র ছওয়াব থেকে বঞ্চিত হবেকিন্তু বিদআত হয়ে থাকলে গোনাহ্ হবে। তাই ইমাম আবু হানিফা রাহএমন কাজ ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করতেন। আর ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় এড়িয়ে চলাই জ্ঞানির কাজ। আল্লামা সারাখসী[10] লিখেন:
"وما تردد بين البدعة والسنة يتركه لأن ترك البدعة لازم وأداء السنة غير لازم ".(المبسوط،2-146)  
‘‘আর যে বিষয়টি বিদআতও হতে পারে আবার সুন্নাতও হতে পারে বলে উভয় সম্ভাবনা রয়েছে এমন বিষয় পরিত্যাগ করবেকেননা বিদআত পরিত্যাগ করা অপরিহার্য জরুরীআর সুন্নাত পালন করা অপরিহার্য নয়।’’[11]
তিনি অন্যত্র লিখেন:
"وما تردد بين المباح والبدعة لا يؤتى به فإن التحرز عن البدعة واجب... وما تردد بين السنة والبدعة لا يؤتى به".(3-357)
‘‘যে বিষয়টি বৈধও হতে পারে আবার বিদআত হতে পারে বলে উভয় সম্ভাবনা রয়েছে এমন বিষয়ের উপর আমল করা যাবে নাকেননা বিদআত পরিহার করে চলা ওয়াজিব,... এবং যে কাজ সুন্নাতও হতে পারে আবার বিদআতও হতে পারে বলে উভয় সম্ভাবনা রয়েছে এমন কাজ করা যাবে না।’’[12]
       এই ছিল খাইরুল ক্বুরুন থেকে নিয়ে হানাফী মাযহাবের মূলধারার আলেমদের আদর্শ। তাই বিভিন্ন দো দুরূদ ইত্যাদির মাঝে নতুন যে কোনো সংযোজনের সবই তাদের যুগের অনেক পরের সৃষ্ট বলে দেখতে পাবেন।
এখন বিভিন্ন আমলআমলের বিভিন্ন পদ্ধতিদুরূদের বিভিন্ন পদ্ধতিযিকরের বিভিন্ন পন্থাসংযোজন বিয়োজন। দোযিকরতাসবীহতাহলীল ইত্যাদির নতুন সংখ্যা  তার লাভ নির্ধারণ। ইবাদতের নতুন নতুন উদ্দেশ্যের প্রণয়ন করে যদি বলি তা বিদআত নয় তবেআমি আমার নিজেকে সম্বোধন করে বলবতুমি পৃথিবীর কাউকে বিদআতি বলে আখ্যায়িত করো না। রাসূলের আদর্শ  উদ্দেশ্য বর্জিত হয়ে তোমার কাজ যদি বিদআত না হয়তবে যাকে তুমি বিদআতি বলছ তাঁর কাজ বিদআত হবে কেনতোমার বানানো পদ্ধতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পন্থায় না হলেও তুমি তোমার ইলমকুরআনহাদীসযুক্তি ইত্যাদির অকাট্য (?) দলীল দ্বারা জায়েয প্রমাণ করতে পার। তবে তুমি যাকে বিদআতি বলছ তাঁর কাছেও তোমার মত হাজারো দলীল রয়েছে। আলোচনা আর দীর্ঘ না করে আমাদের মূল বিষয়ে চলে যাচ্ছি। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিকভাবে বিদআত বুঝা  তা এড়িয়ে চলার তওফিক দিন। আমীন।

লেখাটির পিডিএফ বা ই-বুক ডাউনলোড করুন এখানে। শেয়ার করে দ্বীন প্রচারে এগিয়ে আসুন।


[1] ইবনু মানযুরলিসানুল আরবমাদ্দাহ ‘ بدع ’, /৬।
[2] আরবী ভাষা  সাহিত্যের ইমাম আবুল হুসাইন আহমদ ইবনু ফারিস ইবন যাকারিয়া আল-কাযবীনি আর-রাযি৩২৯-৩৯৫ হিজরী৯৪১-১০০৪ ঈসায়ী।
[3] ইবনু ফারিসমুজামু মাক্বায়িসিল লুগাহমাদ্দাহ ‘ بدع ’, /২০৭লিসানুল আরবপ্রাগুক্ত।
[4] আবু ইসহাক্ব ইবরাহিম ইবনু মুসা আশ-শাত্বিবী আল-মালিকী৭৯০ হিজরীআল-তিসামপ্রথম অনুচ্ছেদবিদআতের সংজ্ঞা  তার অর্থ.../২৬।
[5] প্রাগুক্ত।
[6] তিরমিযীসুনানরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত ইলম অধ্যায়সুন্নাতকে আকড়ে ধরা এবং বিদআত পরিহার করা অনুচ্ছেদনং:২৬৭৬হাদীস সহীহ।
[7] সহীহুল বুখারীকিতাবুর রিক্বাক্বহাউয অনুচ্ছেদনং৬২১২কিতাবুল-ফিতাননং৬৬৪৩।
[8] মুহাম্মদ ইবন ইসহাক্ব ইব্নু খুযায়মাহ আস-সুলামী২২৩-৩১১ হিজরীসহীহ ইবনু খুযায়মাহনবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খুতবার গুণাবলী অনুচ্ছেদনং ১৮৭৫।
[9] সহীহুল বুখারীসন্ধি অধ্যায়অনুচ্ছেদঅন্যায়ের উপর লোকেরা সন্ধিবদ্ধ হলে তা প্রত্যাখ্যানযোগ্যনং২৫৫০সহীহ মুসলিমবিচার সংক্রান্ত অধ্যায়অনুচ্ছেদবাতিল সিন্ধান্ত খণ্ডন এবং বিদআতি কার্যকালাপ প্রত্যাখ্যাননং৪৫৮৯।
[10] শামসুল আয়িম্মাহ মুহাম্মদ ইবন আহমদ ইবন সাহাল আস্-সার্খাসিহানাফী মাযহাবের অন্যতম মুজতাহিদ আলেম। ওফাত৪৮৩ হিজরীমোতাবেক ১০৮০ ঈসায়ী। (আল-লাম/৩১৫)
[11] সার্খাসীআল-মাবসূত,/১৪৬।
[12] প্রাগুক্ত,/৩৫৭।