ধর্ম সম্পূর্ণ একটা আধ্যাত্মিক ব্যাপার; কিন্তু সংস্কৃতি কি তাই? সুন্দরভাবে, সৎভাবে বাঁচার অর্থ যদি হয় সংস্কৃতি, তাহলে ইসলামের সঙ্গে তার বিরোধ কোথায়? নীতি শাস্ত্রের বিচারে অনেক কিছু পরিত্যাজ্য,
কিন্তু মানুষ হিসেবে আমরা ভালমন্দের সম্মিলনে বেঁচে থাকি। যু্ক্তির বাটখাড়ায় সবকিছু মাপা যায় না বিধায়, ধর্ম দর্শনের সব প্রশ্নের তর্কাতীত জবাব পাওয়া সম্ভব নয়।
জীবন একটি চেতনার অন্য নাম; সমাজ ও সংস্কৃতির মধ্যেই তার বিকাশ সার্থক। ধর্মকে আমরা সংজ্ঞায়িত করতে পারি কিন্তু বর্জন করতে পারি না। ধর্মের সংজ্ঞা যাই হোক, মানব জীবনের অনন্ত পিপাসা নিবৃত্তির প্রতিশ্রুতি কেবল, বিশ্বাসীদের মতে, ধর্মই দিতে পারে। ধর্ম যখন মানুষকে শাস্তির ভয় দেখায়, নিরপেক্ষভাবে বলতে হবে, মানব জীবন ও সমাজব্যবস্থায় তা আরোপ করতে চায় নিয়ন্ত্রণবাদ। এটা উচ্ছৃংখল সমাজের জন্য অকল্যাণকর নয়। আমরা দেখেছি, ধর্মকে উপেক্ষা করে মানুষ বাঁচে; কিন্তু পরম সত্ত্বার ধারণা যুগ যুগ ধরে মানুষ যেভাবে লালন করছে তার কোন সার্থকতা থাকে না। ব্যক্তি ধর্মহীন হয়ে বাঁচতে পারে, কিন্তু সমাজ ধর্ম ত্যাগ করে বাঁচতে পারে না। সংস্কৃত ভায়ায় ধর্ম কিংবা ইংরেজি ভাষায় রিলিজিয়ন যাই বলা হোক, মানুষের জীবনকে ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করা, তাকে ন্যায়, সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের তথা পরম সত্ত্বার সন্ধান দেয়াই তার কাজ। ধর্মে অতীন্দ্রিয় জগতের এমন কিছু বিশ্বাস জড়িত আছে যা মানবতার চেয়ে অদৃশ্যমান শক্তিতে বিশ্বাস ধর্মের মৌলিক সত্য বহন করে এবং এই বিশ্বাসে ভর করে মানুষের মনে দেখা দেয় ভয়, ভক্তি, প্রেম ও আনুগত্য; আবেগ ধর্মে জড়িত থাকে। ধর্ম ছাড়া মানব জীবনের অন্য কোন কিছু এতটা অতিপ্রাকৃত মহিমায় অভিষিক্ত নয় এবং ধর্মে প্রত্যাদেশের বিষয়টা অবধারিত। মানুষ ও তার স্রষ্টার সঙ্গে নিবিড় ঐক্য স্থাপন ধর্মের উদ্দেশ্য। (Lord Northbourne. Religion in the modern world, London, 1963, Paige-1-12)
ধর্মের রূপতাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় ধর্মবেত্তাগণ অনেক কিছু বলতে পারবেন, এ কথা সত্য, কিন্তু ধর্মকে মানুষের সত্যিকার কল্যাণে নিয়োজিত রাখা সত্যি কঠিন ব্যাপার। কারণ, মানব ইতিহাসে ধর্ম নিয়ে যথেচ্ছা বাড়াবাড়ির জন্য সর্বাধিক রক্তপাত ঘটেছে এবং বর্তমান যুগে বিশ্বব্যাপী যে হানাহানি চলছে তার অধিকাংশ প্রেরণা বোধ আসছে ধর্মীয় উগ্রতা থেকে। মানুষ কেন প্রার্থনা করবে, কীসের প্রার্থনা করবে? মানুষকে এই প্রশ্নের জবাব দেয় ধর্ম। ফলে, দুর্বলচিত্ত, অভাবগ্রস্ত মানুষের কাছে ধর্ম একটি প্রয়োজন, ঈশ্বর একটি অবধারিত সত্যের নাম। কিন্তু সামাজিকভাবে যারা অভাবমুক্ত. স্বাধীন ইচ্ছায় চালিত, তাদের কাছে অন্য কোন শক্তিতে আত্মনিবেদন তীব্র কোন প্রয়োজন নয়, একটি ফ্যাশন এবং সে কারণে ধর্মের বহিরাবরণটা তাদের চিন্তা ও চেতনার কাছে আকর্ষণীয়। এটা আমরা অস্বীকার করতে পারি না যে মানুষের অন্তর্গত ভাবনা-বেদনার প্রকাশ তার পরিবেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না; নিশ্চয় হয়, এবং হতে বাধ্য। যে সমাজে মানুষ প্রত্যক্ষ করে ধর্মভীরুদের ভণ্ডামী ও অত্যাচার ক্রমবর্ধমান, সেই সমাজ এক সময় ঈশ্বর ও ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। এবং প্রশ্ন তোলে সত্যি তাদের জন্য কোন ঈশ্বর আছে কিনা? অনেকে মনে করেন, ধর্মে মানুষের প্রার্থনা ও আনুগত্যের দাবিদার যে পবিত্র ঈশ্বরের কথা বলা হয়, তিনি আসলে সে রকম কোন ঈশ্বরই নন, বরং সমাজের মানুষের আনুগত্যের দাবিদার সমাজেরই প্রতিফলন। ব্যাক্তির চারপাশে যে সামাজিক সত্তা পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে সেটিই প্রতীকায়িত হয়েছে ঈশ্বর ও ধর্মের নামে। এটা সমাজ বিজ্ঞানীর দৃষ্টিভঙ্গি।
ধর্মকে কি ভয়ার্ত মানুষের অভিজ্ঞতা বলা যায়? ধর্মের কেন্দ্রিয় বক্তব্যে সব কিছু লয়-প্রলয়ের হুশিয়ারী আছে। যুক্তির শাশ্বত শৃঙ্খলার মধ্যে সত্যকে যাচাই করা যায় না। ক্ষুদ্র মোমবাতির আলো কখনো সূর্যের আলোকে যাচাই করার জন্য প্রতীক হিসেবে ব্যাবহার করা যায় না। সকল মানুষ অস্বিকার করুক তাদের স্রষ্টাকে, তবুও এই আকাশ, নক্ষত্রমন্ডল, সাগর-নদী ও পাহাড়সহ বিশ্বলোকের বৈচিত্র নিতান্ত উন্নাসিকের মনেও প্রশ্ন সৃষ্টি করে- নিশ্চয়ই এসবের একজন স্রষ্টা আছে। তাহলে ধর্ম সত্য। ধর্ম সত্য কেবল কিছু বিধি-বিধানের জন্য নয়, চিন্তাশীল মানুষের প্রজ্ঞাই সাক্ষ দেয়, অমরতার আকাংক্ষাই মানব জীবনে ধর্মের অস্তিত্বকে শাশ্বত করে তোলে। ধর্ম যুক্তির চেয়ে বিশ্বাসের পোষকতা করে বেশি। কারণ অদৃশ্য স্রষ্ট, ফেরেশতা, বেহেশত, দোযখ ও পরকাল সম্পর্কে নি:শংসয় বিশ্বাসই ধর্মেল মৌল ভিত্তি। এ গুলো বিশ্বাস করতে মানুষের যতই কষ্ট হোক-বিশেষত ইসলাম পালনের ক্ষেত্রে এগুলো বিশ্বাস না করে কোন উপায় নেই। এক্ষেত্রে মানব মনের আবেগ কাজ করে। মানুষের জীবনকে ঘিরে নেই অখন্ড সুখ, আছে অসংখ্য দু:খ কষ্ট; তাই দু:খ কষ্ট থেকে আছে পরিত্রাণ পাওয়ার উদগ্র আকাঙ্ক্ষা এবং সাধনা। ফলে ধর্মেল ভিত্ত্বি বিশ্বাস হলেও, মানবজীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে তাকে যুক্তির আলোয় পথ চলতে হয়। ব্যাক্তির আরাধনায় বিশ্বাসের প্রাধান্য থাকতে পারে, কিন্তু সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয় নীতিগত যুক্তির শৃঙ্খলার উপর। ধর্মেল লক্ষ্য একক কোন ব্যক্তিমানসের পরিবর্তন নয়, একটি বিশ্বাসী সমাজ প্রতিষ্ঠাই ধর্মের উদ্দেশ্য। ধর্মের পশ্চাতে এক মহান ব্যাক্তির ছায়া আছে, কিন্তু সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে জীবনের সার্বিক পরিবেশকে আশ্রয় করে। এ কারণে সংস্কৃতির বৈচিত্র্য লক্ষণীয় ব্যাপার। সংস্কৃতিকে আমরা নানাভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারি। সংস্কৃতির ইংরেজি শব্দ Culture এর অর্থ হল কর্ষণ করা বা চাষ করা। ব্যাপক অর্থে পরিশীলিত করা বা মার্জিত কিংবা সুন্দর করা।
ইউনেস্কো সম্মেলনে ১৯৮২ সনে সংস্কৃতির ব্যাখ্যায় বলা হয়, "ব্যাপক অর্থে সংস্কৃত একটি জাতির অথবা সামাজিক গোত্রের বিশিষ্টার্থক আত্মিক, বস্তুগত, বুদ্ধিগত এবং আবেগগত চিন্তা এবং কর্মধারার প্রকাশ। শিল্প ও সাহিত্যই সংস্কৃতির অন্তর্ভূক্ত একমাত্র বস্তু নয়, মানুষের জীবন ধারাও সংস্কৃতির অঙ্গ। মানুষের অধিকার , মূল্যবোধ, ঐতিহ্য এবং বিশ্বাসও সংস্কৃতির অঙ্গ"।
টেইলর বলেন, Culture is the complex whole which includes knowledge, belief, art, moral, low custom and any other capabilities and habits acquired by men as a member of society. আর্থৎ- সংস্কৃতি হল মানুষের অর্জিত জ্ঞান, বিশ্বাস, কথা, নীতিনিয়ম, সংস্কার ও অন্যান্য বিষয়ে দক্ষতার জটিল সমাবেশ।
সংস্কৃতি হল সুন্দরভাবে বাঁচা, পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হওয়া। সংস্কৃতি ও ধর্মের মধ্যে মোতাহার হোসেন চমৎকারভাবে পার্থক্য নিরূপণ করেছেন। সংস্কৃতি চায় জীবনকে বিকশিত করতে, কারণ সেটা জীবনের আর্ট। আর ধর্ম চায় জীবনকে পাপ থেকে, পতন থেকে রক্ষা করতে। কারণ ধর্মের পেছনে আছে একজন স্রষ্টা, সংস্কৃতির পেছনে আছে মানুষের জাগ্রত চেতনা। তাই ধর্মের মৌলিক নীতির বদল ঘটে না। কিন্তু সংস্কৃতির রূপান্তর ঘটে। যেমন শিল্পের মধ্যে শিল্পীর ব্যাক্তিত্ব বিভিন্ন যুগের প্রভাবে বিভিন্ন মাত্রায় বিকশিত হয়।
জাতি হয়ে উঠার জন্য ঐতিহ্যের বিকল্প নেই। আর ঐতিহ্যই সংস্কৃতির কেন্দ্রভূমির রচয়িতা। একটি সমাজ বা জাতিকে দূর থেকে চেনা যায় তার সংস্কৃতির জন্য। ধর্মীয় বিশ্বাসে আমরা ৫৭টি দেশের সব নাগরিক মুসলমান; কিন্তু জাতিগতভাবে সংস্কৃতির পার্থক্যের জন্যই আমরা কতটা স্বতন্ত্র! আবার এ কথাও আমরা বলতে পারি, পৃথিবীর সকল প্রকার সংস্কৃতি মানবজাতির ঐতিহ্য। একটি জাতির সার্বভৌমত্ব স্বাধীনতা এবং অভিজ্ঞান সংস্কৃতির মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। সংস্কৃতির পরিশীলিত চর্চার মাধ্যমে আত্মিক, মানবিক এবং পার্থিব ইচ্ছার বিকাশ ঘটে। একথা সত্য, ব্যাক্তির সাংস্কৃতিক বোধ পরিবার থেকে, পারিবারিক ও সংস্কৃতিক মান আসে সমাজ থেকে ও সমাজের সাংস্কৃতিক পরিচয় আসে জাতি থেকে।
ইসলাম একটি ধর্ম, সে ধর্ম মানুষের জন্য দিয়েছে একটি জীবন ব্যবস্থা। সেই জীবন ব্যবস্থার আঙ্গিকের মধ্যেই যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, সেটাকে আমরা ইসলামী সংস্কৃতি বলতে পারি। ইসলাম প্রদর্শিত জীবনের গতিপথ-সরল, কিন্তু কঠোর। কঠোর এ কারণে যে, চোখের সামনে এতীমের সম্পদ থাকবে, ভোগ করা যাবে না, যে আল্লাহকে দেখা যায় না, তাকে খাটি মনে মৃত্যু পর্যন্ত পতিদিন পাঁচবার নামাযের মাধ্যমে ডাকতে হবে, কঠোর ভাবে নৈতিকতা বজায় রাখতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। আধুনিক কালে চারপাশে লোভ লালসা ছড়িয়ে থাকা মানুষের জন্য এগুলো নিশ্চয়ই কঠিন। এ কারণে ইসলামী জীবনের সংস্কৃতিটা উচ্ছৃঙ্খল জীবনের নয়, সম্পূর্ণ যুক্তিপূর্ণ এবং ব্যাতিক্রমী। ইসলামী শরীয়া মুসলমানদের জন্য যে আইন রচনা করেছে, ইসলামী সংস্কৃতির ভিত্তি সেটাই। এর বাইরে যা কিছু আছে বা ঘটবে, ইসলামের নামে সেটা মূলত সাধারণ সংস্কৃতি যার শেকড় আরব-অনারব জাতিগোষ্ঠির নিজস্ব ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গভীরে প্রোথিত। একটি বিষয় আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, আরব ভূ-খন্ডে ইসলাম প্রতিষ্ঠালগ্নে, আল্লাহ অতীতের যে সকল অনাচার ও কুসংস্কৃতি বাতিল করে দিয়েছেন, কোন অজুহাতে, বিশ্বের কোন দেশে কখনো সে ধরনের কোন আচার-অভ্যাস ইসলামের ভেতরে যাতে প্রবেশ করতে না পারে সে বিষয়ে সতর্ক থাকা আবশ্যক। যেমন যে পৌত্তলিকতা উচ্ছেদ করে ইসলামের প্রতিষ্ঠা, সেই পৌত্তলিক মানসিকতা নতুনভাবে ভিন্নরূপে বা আঙ্গিকে যদি ইসলামের মধ্যে প্রবেশ করে তাহলে বুঝতে হবে; আমরা ইসলামের পবিত্রতা রক্ষায় সম্পূর্ণ ব্যার্থ। আমরা জানি, প্রত্যেক জাতির বাপ-দাদাকালীন কিছু সংস্কার বা প্রথা চলে আসছে, যা ত্যাগ করে আসা একটি কঠিন কাজ। বিশ্বের সকল মুসলমানদের মধ্যে এক মাস রোযা পালন, বছরে দু'বার ঈদ উদযাপন কিংবা সামর্থবানদের হজ্জ্ব পালন এ সব ধর্মীয় বিধি-বিধান পালনে সাদৃশ্য থাকলেও বিভিন্ন জাতির মধ্যে চিন্তা চেতনায়, জীবনাচারে যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান এবং সেটাকে আমরা প্রত্যেক ব্যাক্তির নিজস্ব সাংস্কৃতিক ও উত্তরাধিকারের মধ্যে পার্থক্য বলে মনে করি। একজন ভারতীয় মুসলমান এবং একজন আরবীয় মুসলমানদের মধ্যে ধর্মবোধে পার্থক্য নেই। কারণ তারা উভয়ে ইসলামের অনুসারী; কিন্তু তাদের জীবন ভাবনা ও সামাজিক আচারে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। যেহেতু একজন জাতিতে আর্য, অন্যজন সেমেটিক। আফ্রিকার সুদান বা নাইজেরিয়ার মুসলমানের সঙ্গে একজন কাজাক বা তাতার মুসলমানের সঙ্গে পার্থক্য ঠিক একই কারণে বিদ্যমান। কারণ একজন নিগ্রোয়েড অন্যজন ইউরোপিয়েড। একজন কে বাস করতে হয় মরুর লু হাওয়ার উষ্ণতার মধ্যে, অন্যজনকে সাইবেরিয়ার শীতল হাওয়া থেকে রক্ষার জন্য পড়তে হয় ভেড়ার লোমের তৈরী গরম পোশাক।
আমরা মনে করি, শিল্প সাহিত্য ও সঙ্গীত সাধারণ সংস্কৃতি। কিন্তু না, এ গুলো হল সংস্কৃতির বাহন। সংস্কৃতি একটি চেতনা, মৌলিকবাবে একটি জীবন চেতনা। আবার এই চেতনা ছড়িয়ে থাকে গৃহ নির্মানে, পোশাক পরিচ্ছেদ, আসবাব পত্রে, শিক্ষায়, শিল্পে-সাহিত্যে এবং অর্থনীতি ও রাজনীতিতে; এমনকি পুরোহিতের বিয়ে অনুষ্ঠানের মন্ত্রপাঠেও। এ কারণে আমরা একজন মানুষকে জোর করে অন্যজনের মত ও মতবাদ গ্রহনে বাধ্য করতে পারি না। মানুষ নদী ভাঙ্গনে ঘরবাড়ী হারালে পুন:নির্মান করে নেয়; কিন্তু সে তার ধর্ম ও সংস্কৃতি হারালে তার কিছুই থাকে না। আমরা বাঙালি মুসলমান, পায়জামা-পান্জাবী এবং শাড়ী পরায় অভ্যস্ত, আমরা তুর্কীদের মতো মাথায় হ্যাট ও প্যান্ট পরে আরামবোধ করব না। যদিও আমরা উভয়ে এক ধর্মাবলম্বী। বাঙালীদের জারী গানের আসর আর রাশিয়ানদের বল ড্যান্স, পশ্চিম ইউরোপের নাইট ক্লাব সংস্কৃতি আর আফ্রিকানদের উদাম দেহে রং মাখা নৃত্য-কখনো কি তাদের জীবনাচার থেকে মুছে ফেলা যাবে? আমরা এটা অকাট্য বলে করতে পারি না যে, সংস্কৃতির রূপান্তর ঘটে না। আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন মানুষের জীবনপদ্ধতিতে যখন মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে আসে, নতুন উদ্ধুত পরিবেশে মানুষ তার সংস্কৃতির মধ্যেও কিছু পরিবর্তন কে মেনে নেয়। ঊনিশ শতকীয় কলকাতায় নব্য বাবু শ্রেণীর উদ্ভব এবং একুশ শতকের ঢাকায় গুলশান-বনানী-ধানমন্ডি-উত্তরার উচ্ছৃঙ্খল তারুণ্যস্রোত- হঠাৎ অর্থে বিত্তে শক্তিমান এক অমিতাচার শ্রেণীর উত্থান বাঙালীর ঐতিহ্য বিরোধী হলেও, যুগের ফসল হিসেবে এ সমাজেরই একটি অংশ হওয়ার দাবিদার।
সাম্রাজ্যবাদ কিভাবে জাতি-উপজাতির মৌলিক শিক্ষা ও সংস্কৃতি ধ্বংস করছে, তা কেবল ভয়াবহ যুদ্ধের প্রত্যক্ষ পরিণাম হিসেবে দেখছি না; তা নিরন্তর ঘটে চলছে স্বাভাবিক শাসন প্রক্রিয়ার মাধ্যমেও। কিপলিং এর একটি গল্পে, দার্জিলিং এর পাহাড়ী এলাকার কাছাকাছি একটি বাংলোতে এক বৃটিশ পরিবার বাস করত। ইংরেজ মহিলা বাসার কাজের জন্য স্থানীয় এক উপজাতি-মেয়েকে রেখেছেন। দীর্ঘদিন মেয়েটি বাসায় দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে। ইংরেজ মহিলার দূর সম্পর্কীয় এক ভাই ইংল্যান্ড থেকে ভারতবর্ষ ভ্রমনে এসে মাস তিনেক তার বাসায় থাকল। ভদ্রলোক অবিবাহিত এবং শিক্ষিত; উপজাতীয় কাজের মেয়ের সঙ্গে তার প্রেম সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং সে মেয়েটিকে কথা দেয় তাকে বিয়ে করে বৃটেন নিয়ে যাবে। বিষয়টি গৃহকর্তী জানল এবং মেয়েটিকে ইংরেজদের মত চলা, কথা বলা, প্যান্ট পড়া থেকে শুরু করে অনেক কিছু শেখালেন; এবং মেয়েটা ভালবাসার টানে ঘরের কাজে আরো মনোযোগ দিল। ভদ্রলোক একদিন বলল, আমি ইংল্যান্ড যাচ্ছি, বাবা-মাকে নিয়ে আসব, শীঘ্রই এসে তোমাকে বিয়ে করব। মেয়েটা ঘাড় নেড়ে সম্মতি দেয় এবং তাকে শেষ বিদায় আলিঙ্গন করে। ভদ্রলোক ইংল্যান্ডে গেলেন প্রায় একমাস, মেয়েটা তার কথা মনে করে এবং উৎসাহের সঙ্গে ঘরের কাজ গুছিয়ে রাখে, ইংরেজ মহিলার ফাই-ফরমায়েশ খাটে। মাঝে মাঝে গৃহকর্তীকে ঐ লোকটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে, মহিলা বলেন, এই তো আসবে, এ মাসে না হলেও, আগামী মাসে বাবা-মা কে বুঝিয়ে আনবে, তারপর তো; তুমি নিশ্চন্ত থাক। এভাবে তিনমাস অপেক্ষার পর মেয়েটা সত্যি যখন বুঝতে পারল, সে একটি প্রতারণার শিকার হয়েছে, তখনই সে তার মাথার ব্যান্ড, প্যান্ট-শার্ট, রাত্রিবাসসহ ইংরেজ মহিলার দেয়া সব কিছু খুলে রেখে যে পোশাক পড়ে সে প্রথম এ বাড়ীতে এসেছিল, সেই ঢিলা ব্লাউজ, আর লুঙ্গির মত কাপড়টা পড়ল, মাথার চুল আবার বেনী করে বাঁধল, পায়ের জুতাটাও খুলে রাখল এবং সে ইংরেজ মহিলার সামনে গিয়ে আদিম উপজাতিয় হয়ে দাঁড়াল, লিপিষ্টিকহীন ঠোটে সাদামাটা অথচ কাঁটাকাঁটা উচ্চারণে বলল, আমি যাই। 'তুমি কোথায় যাচ্ছ? তোমার এ অবস্থা কেন? ইংরেজ মহিলার প্রশ্ন। আপনার কোন কিছু আমি নেইনি, সব কিছু পাকঘরের মেঝের ওপর রইল, আমি যাচ্ছি আমার আর ফেরা হবে না। 'এসব কি বলল তুমি?'
আমি আর এখানে আসব না, আপনি অন্য মেয়ে খোঁজ করুন, বলে মেয়েটি এক দৌঁড়ে তার সম্প্রদায়ের সঙ্গে গিয়ে মিশল। ইংরেজ মহিলা দূর থেকে তাকিয়ে দেখল সে তার পীঠের ওপর বেণী দুলিয়ে দৌঁড়ে যাচ্ছে যেমন অন্য উপজাতীয় মেয়েরা দৌঁড়ায়।
সাম্রাজ্যবাদ প্রতারণা ও কুটিলতার শিক্ষা দিয়েছে কিন্তু প্রকৃতির কোল লগ্ন উপজাতির মধ্যে সরলভাবে বিশ্বাস এখনো অটুট। সত্যতা তারা হয়ত গ্রহণ করে না সরলতা বিনষ্টের আশংকায়। আমরা ঐ উপজাতি মেয়েটির মত, ইংরেজদের দুশোবছরের শাসন শোষণ মেনে নিয়েছি, কিন্তু সংস্কৃতি গহণ করিনি। কারণ ওরা বণিক, ওরা কপট, ওরা হিংস্র।
সংস্কৃতি যদি হয় সুন্দরভাবে বাঁচার অনন্য প্রেরণা; ইসলাম তাহলে সেই প্রেরণার মৌলিক উৎস। অনেক ব্যাখ্যাকার বলেছেন, ধর্ম সংস্কৃতির উপাদান। আমরা বলব, ধর্ম সংস্কৃতির উৎস। ইসলাম কেবল ইহকালের জীবনে সুন্দরভাবে বাচার প্রেরণা যোগায় না, সে পরকালের জীবনেও নিরাপত্তার কৌশল শিক্ষা দেয়। ইসলামী সংস্কৃতির মূল প্রোথত হল, দর্শনগত দিক থেকে, বিশ্বাসী মানুষের অন্তরে। মুসলমানদের সকল কর্মনীতি নির্ভর করবে তার খোদায়ী অস্তিত্বে দৃঢ় বিশ্বাস রাখার উপর। যার মধ্যে অদৃশ্য বিষয়ে বিশ্বাস নেই তার কাছে ইসলাম কিছুই আশা করে না। যদি একজন অতিথিকে আপ্যায়নের পদ্ধতির মধ্যে সংস্কৃতির প্রকাশ পায়, তাহলে বুঝতে হবে, খাবার পরিবেশনের পদ্ধতিটা হল সংস্কৃতি; কিন্তু অতিথি যদি নাই আসে, খাবার পদ্ধতি রচনার প্রশ্ন উঠে না। ইসলামে একাত্মবাদে বিশ্বাস যেমন মৌলিক বিষয়, ইসলামের জীবন রক্ষা করার জন্য শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ করাও তেমনি অনিবার্য ব্যাপার। জিহাদও ইসলামী সংস্কৃতির অন্যতম বিষয়। সাধারণভাবে প্রকৃতির আঘাত থেকে রক্ষা করা যেমন কর্তব্য, তেমনি অবিশ্বাসীদের আক্রমন থেকে আত্মরক্ষার জন্য যুদ্ধ করা দায়িত্ব। সেই সঙ্গে কোরআন ও হাদীসের আলোকে জীবনকে সুশৃঙ্খল করাও সংস্কৃতির অঙ্গ। আবার এও মনে রাখতে হবে, মানুষ শুধু চব্বিশ ঘন্টা ধর্ম কর্ম নিয়ে পড়ে থাকবে, তা হয় না; সময়কে উপভোগ করার জন্য তাকে শিল্প চর্চা করার প্রয়োজনও হয়। ড:সাইয়েদা ফাতেমা সিদ্দীকা বলেন, A Culture is a code of life, to be more precise a code of human conduct for the development of human life and ideal. যেহেতু কোরআন পরিপূর্ণ একটি শান্তিময় জীবন বিধান, সেহেতু কোরআন এর অনুগত জীবন যাপনই ইসলামী সংস্কৃতিকে সম্পূর্ণতা দিতে পারে। কোন অজুহাতে ইসলামের সংস্কৃতি পরিপন্থী জীবন যাপন করার অর্থ হল ইসলামের মূল শক্তিকে ধ্বংস করা এবং মুসলিম মিল্লাতকে পঙ্গু করা।
পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রভাবে যারা মুসলিম সমাজে বাস করেও, অপসংস্কৃতির চর্চা করছে, তারা এ জাতির পুনর্গঠনের সময় আত্মত্যাগে আগ্রহী হবে না, বরং বিরোধীতা করবে। অহেতুক অর্থ ও কৌলিন্যের অহংকারে তারা যথেচ্ছা জীবনাচারে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। তারা ভূঁইফোড় একটি বিচ্ছিন্ন জনতায় পরিণত হয়েছে। অথচ তাদের বোঝা উচিত, ইসলাম কে পরিপূর্ণ করার জন্য নতুন কোন বিধি-বিধান সংযোজনের প্রয়োজন নেই। জীবনকে অবসরে উপভোগ করার জন্য পাশ্চাত্য দুনিয়া যে সব উপায় উদ্ভাবন করেছে, তা প্রধানত নারী ও মদের রকমারী ব্যবহার বলতে হয় এবং সেখানে মানব মনের নান্দনিক তৃষ্ণা মেটানেরা পরিবর্তে, দৈহিক কামনা বাসনাই বেশি প্রাধান্য পায়। সে কারণে পাশ্চাত্যের অনুকরণে এদেশে ছবি-ছিনেমার বিস্তার ঘটছে, সেগুলো নগ্ন যৌন আবেদনে পরিপূর্ণ। এটা মৌলিকভাবে ইসলামের নৈতিকতা বর্জিত, শয়তানি কর্মকান্ড। যেহেতু নারী ও মদ যখন একত্র হবে, তখন অবশ্যই সেখানে অপকর্ম প্রাধান্য পাবে এবং ভোগ বিলাসিতার মধ্যে মনকে বন্দী করে ফেলবে। নারী মোহ সৃষ্টি করে, মদ জাগিয়ে দেয় উত্তেজনা। তারপর চর্চা হয় পাপের। এগুলোই হচ্ছে আধুনিক পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রধান উপকরণ এবং সেগুলোর ঢেউ এখন আছড়ে পড়ছে তৃতীয় বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোতে।
দেশের ইসলামপ্রেমী চিন্তাবিদগণ, অপসংস্কৃতির ক্রমবর্ধমান জোয়ারে আতঙ্কিত। প্রতিরোধের জন্য চলছে ব্যাপক ওয়াজ মাহফিল এবং ঈমানদ্বারদের মনে পরকালীন ভয় ধরিয়ে দেয়ার মত কাহিনী পরিবেশিত হচ্ছে। ইসলামী জীবনকে কিভাবে রক্ষা করা যায়, এ চিন্তা সকলের; কিন্তু কার্যকর উপায় পাওয়া যাচ্ছে না। প্রত্যক্ষ পরাধীনতার চেয়েও ভয়ংকর এই অপসংস্কৃতির আক্রমণ। ক্ষেপনাস্ত্র মধ্য আকাশে প্রতিরোধ করা যায়; কিন্তু সাংস্কৃতিক আক্রমণ প্রতিরোধের ব্যবস্থা কি? ইসলামের নিজস্ব সংস্কৃতি বলতে কি কিছুই থাকবে না?
আধুনিক ইউরোপিয় বিজ্ঞান যেমন গোটা বিশ্বকে অধম দাসে পরিণত করেছে, তেমনি তাদের সংস্কৃতিও কি সকল জাতির জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে যাবে? যদি তাই হয়, তাহলে বিশ্ব সভ্যতা বলতে কি থাকবে? বৈচিত্র ও বিভাজন, যা প্রত্যেকটি জাতির প্রাতিস্বীকতায় ওজ্জ্বল্য-তা হারিয়ে গেলে বিশ্ব পরিচয়ের কি থাকবে? যুক্তি ও বিজ্ঞান মিলে ইউরোপিয় সংস্কৃতি যা বস্তুবাদী বা একেবারে পার্থিবমুখী জীবনযাপনের নেশা জাগিয়ে দেয়, সেটাই যদি হয় দৈনন্দিন জীবনাচারের নিয়ন্ত্রক, তাহলে আমরা যে পারিত্রিক জীবনের কল্যাণ প্রত্যাশী তা কিভাবে অর্জিত হবে? ইউরোপীয় জীবন-সংস্কৃতির নগ্নতাটুকু বাদ দিলে, বাকীটা তো অস্বীকার করা যায় না। কারণ সেটার একটা দৃঢ় ভিত্তি তারা দিয়েছে। সেটা হল ইহ জাগতিক অস্তিত্ববাদ এবং বিজ্ঞানবাদ। যদিও এ দুটোই তারা নিয়েছে, অষ্টম থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত বিকশিত মুসলিম দর্শন ও সংস্কৃতির প্রেরণা থেকে। পরবর্তিতে এর সঙ্গে তারা যুক্ত করেছে বিশ্বজয়ের নেশা, যা মুসলিমরা করেনি।
বর্তমান যুগে, মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শক্তিহীন, পরাজিত মুসলিম বিশ্ব এখন একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মধ্যে বন্দী এবং আহত অবস্থায় খাবি খাচ্ছে। সেই সঙ্গে সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির দিকে তাকালে দু:খ বোধের করুন ছায়া এসে পড়বে আমাদের মলিন মুখে। বিশ্বের রাজনৈতিক শক্তি হারিয়ে মুসলমানরা এখন সাংস্কৃতিক পরাজয়টাকে হজম করছে। যে সব বিষয় নিয়ে তারা পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে দাড়াতে চাচ্ছে, তা চাপদাড়ি ভরা মুখ গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসা ব্যথ আসফালনের অহেতুক উচ্ছ্বাস ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ কোরআন যে আইনের শাসনের কথা বলে, মুসলমানরা সেটা অনেক আগেই ত্যাগ করেছে। জনৈক নাস্তিকের ভাষায়, যাদের দাড়িতে সত্তর হাজার ফেরেশতা বাস করে তাদেরকে আবার ময়দানে গিয়ে যুদ্ধ করতে হয় নাকি? নবীর (স:) সুন্নতের দিকে এরা এত বেশী জোর দিয়েছেন যে ঘন ঘন তাবলিগে যাচ্ছে কিন্তু পবিত্র কোরআনে আসলে কি আছে তা মাতৃভাষায় পাঠ করার প্রয়োজনও বোধ করছে না। বেদও হিন্দুদের ধর্ম গ্রন্থ, কঠিন সংস্কৃত ভাষায় রচিত; শতকরা ৯৮% জন হিন্দ বেদ-এর নাম শুনেছে, চার খন্ড বেদ তাও শুনেছে কিন্তু পড়েনি, অনেকেই কেবল উপনিষদ দিয়ে কাজ চালায় ব্রাক্ষাণ শ্রেণী আর মনু-সংহিতার শ্লোক নিয়ে ধর্মচর্চা করে বৈশ্য-শূদ্র। এই হচ্ছে হিন্দু ধর্মের হাল অবস্থা। আর মুসলমানরা পাঠ করে বোঝার চেয়ে শুনে বলার ওস্তাদ; অবশ্য দোষ তাদের নয়, দোষ সিরাজ-উদ-দৌলার; কেন সে পরাজিত হয়ে দেশটা ইংরেজদের হাতে দেয়ে গেল, নইলে ঐতিহাসিকভাবে বাঙালী মুসলমানরা নিরক্ষর থাকত ?
বস্তুতপক্ষে, দোষ আমরা যাকেই দেই না কেন, আমেরিকা আমাদের জন্য যে রোডম্যাপ করে দিয়েছে, তা দেখে দেখে চলতে হবে এবং সেটা আগামী কয়েকশ বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল নিয়ে অপেক্ষা করছে।
ইসলামের সংস্কৃতির মধ্যে আমাদের অনিবার্য জীবন। যেহেতু আল্লাহ বলেন, "ইসলামকে বাদ দিয়ে কেহ অন্য কোন মতাদর্শকে দ্বীন বা জীবন ব্যবস্থা গ্রহণ করলে, তা কখনো গ্রহণযোগ্য হবে না। আর আখেরাতে তারা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভূক্ত থাকবে। "( আল-ইমরান : ৮৫)
কিন্তু প্রশ্ন হল, আল্লাহ আমাদের মধ্যে যে রুপ দেখতে আগ্রহী, আমরা কি সেই রূপের সার্থক চর্চা করতে পারছি? ইসলাম ও মুসলমানদের সংকট কিন্তু এখানেই। বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে মুসলিম সংস্কৃতির একটি সর্বগ্রাসী রূপ আছে। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞানচর্চার মহাপুরুষীয় আহ্বান আরব মনীষীরা বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলে ইসলামী জীবন ও সংস্কৃতিকে অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্ব সভ্যতার একটি বিশেষ অংশে তারা পরিণত করতে পেরেছিলেন। আমরা ইসলামী সংস্কৃতির রূপরেখা অঙ্কন করতে গেলে প্রথমে যেতে হয় কোরআনের অমর বণীসমূহের কাছে যার ভেতর তেকে ইসলামী জীবনের শাশ্বত বুনিয়াদ গড়ে উঠেছে।
"তোমরা আল্লাহ ছাড়া কারো উপাসনা করবে না, পিতা-মাতা আত্মীয়-স্বজন, এতীম ও দ্বীন-দরিদ্রের সাথে সদ্ব্যবহার করবে, মানুষকে সৎ কথাবার্তা বলবে, নামায প্রতিষ্ঠা করবে, এবং যাকাত দিবে। (আল-বাকারা:৮৩)
ইসলামী জীবনের কর্মকান্ড লিখে যে সংস্কৃতিটা গড়ে উঠেছে তা আল্লাহর কাছে সতত দায়বদ্ধ। কারণ অহেতুক হাসি ঠাট্টা গালগপ্প করে সময় নষ্ট করার অবকাশ ইসলামে নেই। যদি তা হত আল্লাহ প্রশ্ন করতেন না, 'তোমরা হাসছ, ক্রন্দন করছ না? কিসে তোমাকে গাফেল রেখেছে? স্ত্রী-পুত্র পরিজন, অর্থ সম্পদ এবং কিছু ক্ষমতা, এ ছাড়া মানুষের অহংকার করার কি আছে? অন্তরে আল্লাহর স্থান না দিয়ে মানুষ পার্থিব সুখ-সুবিধার জন্য যা কিছু করছে তাই ইসলামী জীবনের বিপরীত, তা ইসলামী সংস্কৃতির মধ্যে গণ্য নয়। পূর্ব-পশ্চিমে সিজদা করাও ইসলামের নির্দেশ নয়; তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত করা এবং সৎকার্যসমূহের প্রতি একনিষ্ঠ থাকাই ইসলামী জীবনের অঙ্গীকার।
মানব জীবনের কিছু মৌলিক বিষয়ের ওপর ইসলামী বিধান প্রতিষ্ঠিত যা তার সাংস্কৃতিক পরিচয়কে স্বাতন্ত্র্যমন্ডিত করে। যে মৃত্যকে সুদূর পরাহত একটি বিষয় বলে মনে হয়, সেটা যে কোন মুহুর্তে এসে আমাদের প্রাণবায়ু ছিনিয়ে নিতে পারে; অত:পর আল্লাহর প্রতিশ্রুত পরোকালের আশ্বাদ গ্রহণ করতে হবে, আমাদের পার্থিব কর্মফলের ভিত্তিতে। এর মত, জীবনে আর কোন স্থায়ী মৌলিক সমস্যা কিন্তু নেই। এজন্য আল্লাহ নবীর (স:) মাধ্যমে বলেন, "তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ উত্তম বিষয়ের অনুসরণ কর, তোমাদের কাছে অতর্কিতে ও অজ্ঞাতসারে আযাব আসার পূর্বেই। যাতে কেউ না বলে, হায়! আল্লাহর সকাশে আমি কর্তব্যে অবহেলা করেছি এবং আমি ঠাট্টা-বিদ্রুপকারীদের অন্তর্ভূক্ত ছিলাম। (আল-যুমার : ৫৫-৫৬)
ইসলামের সংস্কৃতি তার আইনসংগত ব্যবহারের মধ্যে। আল্লাহর প্রতি আত্মনিবেদন যেমন অপরিহার্য, মানুষের প্রতি ন্যায়সঙ্গত বিচার মিমাংসা করাও তেমনি। মানুষের ইনসাফ বা ন্যায়বিচার মানুষের প্রার্থনাকে যথার্থতা দান করে। "মুমিনগণ! যদি কোন পাপাচারী ব্যক্তি তোমদের কাছে কোন সংবাদ আনয়ন করে, তবে তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখবে, যাতে অজ্ঞতাবশত, তোমরা কোন সম্প্রদায়ের ক্ষতিসাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত না হও (আল-হুজরাত : ০৬)। প্রকৃতপক্ষে অত্যন্ত হিসেবি একটা জীবন ব্যাবস্থা ইসলাম তার অনুসারীদের দান করেছে। For 24 hours, the followers Islam should be alert about their duties and aware of surroundings. কেবল শয়তান সময় নষ্ট করে এবং বিভ্রান্তদের সময় নষ্টের দিকে কুমন্ত্রনা দেয়। নর্তকীর নাচ, বাইজির ড্যান্স, সাকীর শুরা, ভন্ডের জুয়াখেলা আর কুরুচিশীলদের লালসার জন্য যে কৌতুকপূর্ণ সময় অপচয় হয়, একজন জ্ঞাণীব্যক্তি, যিনি বিশ্বাস করেন এ গুলো অর্থহীন উল্লাস, মৃত্যু সন্নিকটে, তিনি সেই অপচয় মেনে নেবেন না। মানুষকে পার্থিব জীবনে যা ক্ষতি করছে তা হলো তার মজ্জাগত অলসতা। অথচ কোরআনে আল্লাহ স্পষ্ট বলেন, নামাজের পর তোমরা বেরিয়ে পড়। অর্থাৎ পার্থিব জীবনে আয় উন্নতির জন্য ন্যায় সঙ্গত পথে পরিশ্রমের জন্য আল্লাহর নির্দেশ। এটা ইসলামী জীবনে সংস্কৃতির একটি বিশেষ দিক।
ইসলাম একটি জ্ঞানাত্মক ধর্ম। প্রত্যাদেশ এবং বাস্তববীক্ষণ এর প্রেরণাশক্তি। সত্যানুসন্ধান এর চরিত্রনীতি; কোরআনিক বিধানের মধ্যে থেকে সৃষ্টিকর্তার ইবাদত ও পার্থিব জীবনকে পরিপাটি করা এর সংস্কৃতি। মানব জীবনকে ঘিরে থাকা সকল অমঙ্গল বোধের বিরুদ্ধে এর লড়াই ও অঙ্গীকার। মানুষের অবরুদ্ধ চেতনার মুক্তির জন্য ইসলাম পর্যবেক্ষণশীল যে দৃষ্টান্তগুলো উপস্থাপন করছে, তা নিছক কতগুলো ঘটনার প্রতিবেদন নয়। বিশ্বপ্রকৃতির গঠনশৈলী ও মানুষের গঠন বিন্যাসকে সামনে রেখে কোরআন যখন মানুষের কাঝে এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের আহ্বান জানায় তখন জ্ঞান সাপেক্ষে উপলব্ধির সূক্ষ্ম চেতনা দিয়ে মানুষ বিশ্বাস করতে অনুপ্রাণিত হয়। এই বিশ্বাসকে পদদলিত করে দেহজ কামনা নানা আঙিকে শির-শিরিয়ে উঠার নাম কি ইসলামী সংস্কৃতি যা বর্তমান সমাজে চলছে?
ইসলামের জীবনবোধ আত্মপবিত্রতার সঙ্গে যুক্ত যেমন শিল্পীর শিল্পবোধ তার তুলি ও রংয়ের সঙ্গে যুক্ত। মানুষের কামজর্জর-লোভাতুর আত্মাকে পবিত্র করার মহৎ উদ্দেশ্যকে খাটো করে ইসলাম কি সুন্দর হতে পারে? অথবা এর সংস্কৃতি? অথচ এ যুগে ইসলামের একটা দিক, সেক্যুলারিজমের আসবাবপত্রের মধ্যে আটকে গেছে। মাঝখানে লক্ষ লক্ষ মুসল্লির ইসলাম কেবল নামাজ ও রোজার মধ্যে এমনভাবে উদযাপিত হচ্ছে যে, মানুষের প্রতি ন্যায়পরায়ণ হওয়া বা অত্যাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর কোন দায়িত্ব নেই। শরীয়া অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে তরবারী তুলে ধরার মুসলমান কি আছে? যারা আছে তারা যে সব নামাজী ও রোযাদার! ইসলাম আসলে এখন পঙ্গু অক্ষমদের আত্মায় কিছুটা শান্তিদানের ধর্মে পরিণত হয়েছে। অসৎ ব্যাবসায়ীর কব্জি কাটার সাহস কার, কেইবা সে দায়িত্ব পালন করবে? যদিও আল্লাহ নিশ্চয়ই ন্যায়পরায়নতা এবং ইহছান-পরোপকারিতা এবং আত্মীয় স্বজনদেরকে দেবার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন এবং তিনি অনিষ্ট ও বিদ্রোহ নিষেধ করেছেন।
ইসলামের মত একটি বৈজ্ঞানিক ও গতিশীল ধর্মের মধ্যে যুগের আবর্জনা জড়িয়ে পড়ার ঐতিহাসিক প্রেক্ষিততো আমাদের জানা উচিত। বৃটিশরা আমাদের আধুনিক বোধ দিয়েছে, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে ইসলামের বিপ্লবী চেতনা। সত্যিকার জীবনের আলো ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা তারা নি:শেষ করে দিয়েছে। শুধু সামাজিক কাঠামো ভাঙ্গেনি, মুসলিম জাতির আত্মার মধ্যে পার্থিব জীবন নেশার অসুখ ঢুকিয়ে দিয়েছে। ফলে পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি অনুসরণ করতে এখন মুসলমানদের অভক্তি জাগে না। মৃত আত্মাগুলোর মধ্যে কলের গাণের মত জিকির শোনা যায়। অসততার মধ্যে, মুসলমানরা ক্রমবর্ধমান জীবনের সার্থকতা সন্ধান করছে যা কখনো সফল হবার নয়।
মুসলিম সংস্কৃতি আজ কতকগুলো প্রথার মধ্যে নির্জীবভাবে পালিত হচ্ছে; কিভাবে তাকে একটি জীবন্ত সত্তায় ফিরিয়ে আনা যায়, সেটা ভেবে দেখার সময় এসেছে। একটি জাতি যখন যুদ্ধে জয়ী হয় অনেক রক্তের বিনিময়ে, তখন সে জাতি কেবল যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে না, সে ভবিষ্যতে যে কোন বিপদে ঐক্যবদ্ধ থাকার অজেয় সম্ভাবনাও নিজের মধ্যে আবিষ্কার করে। এই অসম্ভব শক্তির আবিষ্কৃতির জন্য একটি জাতিকে প্রচুর ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, অন্যথায় জানা যায় না, একটি জাতি সত্যি কত বড় এক মহান জাতিতে পরিণত হতে পারে।
শান্তশীতল স্রোতধারার মধ্যে অবগাহন করে কখনো যেমন টের পাওয়া যায়না, ভুমিকম্প, ঝড় আর টাইফুন ও জলবায়ুর বৈশিষ্ট, তেমনি শুধু রুটিন মাফিক দু-বেলা খেয়ে পরে বোঝা যায় না জীবনে আঘাত ও দু:খ, বিপর্যয় ও হতাশও আছে। ভাঙ্গাগড়ার নিবিড় ঐক্যে মানব জীবন গঠিত। আমরা যা নিয়ে সুখে থাকতে চাই, তা হয়তো মখমলের তাকিয়ায় হেলান দিয়ে আরামে খাওয়া পরা; কিন্তু মানুষের জীবন কি তাই? ইসলামের সংস্কৃতি কি তাই বলে? কোরআনে আল্লাহ স্পষ্ট ঘোষনা করেছেন, 'হে মানুষ, কষ্ট স্বীকার করে অবশ্যই তোমার প্রভুর দরবারে পৌঁছাতে হবে" আমরা শত শত বছরের মানবীয় ইতিহাস পর্যালোচনা করে এ সত্যের প্রমাণ পাই; পৃথিবীতে যে গৌরবময় সভ্যতার বিকাশ দেখা যায় তার পেছনে রয়েছে মানুষের ক্লান্তিহীন পরিশ্রম। ভাবগত ও বস্তুগত উন্নতির পথে কায়িক ও মানসিক পরিশ্রমের কোন বিকল্প নেই। ইসলামের প্রতিষ্ঠাকালীন যুদ্ধে সাহাবীদের নির্ভীক সাহসিকতা যে গৌরবময় ইতিহাস রচনা করেছে, তা ইসলামের ধর্ম-সংস্কৃতি ও সভ্যতার এক অতুলনীয় উপার্জন। সেই যুদ্ধগুলোই আমাদের প্রেরণা।
আলোচনার শেষ প্রান্তে আমরা ধর্ম-সংস্কৃতি ও ইসলামকে ঘিরে আর যে কথাটি বলতে চাই, সেটা হল, ধর্ম ভাববাদের বিষয় হিসেবে আধ্যাত্মিকাতার মধ্যে সীমাবদ্ধ কিছু অনুভাবনা হতে পারে, সংস্কৃতি কোন ধর্মীয় ভাবাবেগ ছাড়াও পার্থিব জীবনের স্বাভাবিক বিকাশধারার ভেতর দিয়ে গড়ে উঠতে পারে। আর আসলাম, একটি ঐশী জীবন বিধান হিসেবে, ভাব ও বস্তুর সমন্বয়ে, দেহ ও আত্মার সমবায়ে পূর্ণাঙ্গ কাঠামোর মধ্যে মানুষের পার্থিব ও পারমার্থিক চাহিদা পূরণের সর্বাধিক গ্যারান্টি দিতে সক্ষম এবং সে কারণে ইসলামী জীবনের শৈল্পিক রূপায়ণ বিশ্বের যে কোন ধর্ম ও সংস্কৃতির চেয়ে অনেক বেশি সমৃদ্ধ ও সমর্থন যোগ্য। ইসলামী জীবনের প্রত্যেকটি আচরণের রয়েছে একটি নৈয়ামিক শৃঙ্খলা, ভাল ও মন্দের সীমানা দ্বারা চিহ্নিত। অতএব একজন খোদাভীরু বিশ্বাসীর জন্য ইসলামের জীবন বিধান থেকেই সঠিক ধর্মবোধ ও সংস্কৃতিকে গ্রহণ করতে হবে।
বি. দ্র. লেখাটি থেকে বিন্দুমাত্র উপকৃত হলে অন্যদের সাথে শেয়ার, কমেন্ট করতে ভুলবেন না। আপনিও হতে পারেন দ্বীন প্রচারের অন্যতম একজন সহযোগী।
এরকম আরো লেখা পড়ুনঃ
সামাজিকতার গুরুত্ব ইসলামে
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ একটি কুফরী মতবাদ
আল্লাহ সুব. অস্তিত্বের একটি বুদ্ধিবৃত্তিক প্রমাণ
কিন্তু মানুষ হিসেবে আমরা ভালমন্দের সম্মিলনে বেঁচে থাকি। যু্ক্তির বাটখাড়ায় সবকিছু মাপা যায় না বিধায়, ধর্ম দর্শনের সব প্রশ্নের তর্কাতীত জবাব পাওয়া সম্ভব নয়।
জীবন একটি চেতনার অন্য নাম; সমাজ ও সংস্কৃতির মধ্যেই তার বিকাশ সার্থক। ধর্মকে আমরা সংজ্ঞায়িত করতে পারি কিন্তু বর্জন করতে পারি না। ধর্মের সংজ্ঞা যাই হোক, মানব জীবনের অনন্ত পিপাসা নিবৃত্তির প্রতিশ্রুতি কেবল, বিশ্বাসীদের মতে, ধর্মই দিতে পারে। ধর্ম যখন মানুষকে শাস্তির ভয় দেখায়, নিরপেক্ষভাবে বলতে হবে, মানব জীবন ও সমাজব্যবস্থায় তা আরোপ করতে চায় নিয়ন্ত্রণবাদ। এটা উচ্ছৃংখল সমাজের জন্য অকল্যাণকর নয়। আমরা দেখেছি, ধর্মকে উপেক্ষা করে মানুষ বাঁচে; কিন্তু পরম সত্ত্বার ধারণা যুগ যুগ ধরে মানুষ যেভাবে লালন করছে তার কোন সার্থকতা থাকে না। ব্যক্তি ধর্মহীন হয়ে বাঁচতে পারে, কিন্তু সমাজ ধর্ম ত্যাগ করে বাঁচতে পারে না। সংস্কৃত ভায়ায় ধর্ম কিংবা ইংরেজি ভাষায় রিলিজিয়ন যাই বলা হোক, মানুষের জীবনকে ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করা, তাকে ন্যায়, সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের তথা পরম সত্ত্বার সন্ধান দেয়াই তার কাজ। ধর্মে অতীন্দ্রিয় জগতের এমন কিছু বিশ্বাস জড়িত আছে যা মানবতার চেয়ে অদৃশ্যমান শক্তিতে বিশ্বাস ধর্মের মৌলিক সত্য বহন করে এবং এই বিশ্বাসে ভর করে মানুষের মনে দেখা দেয় ভয়, ভক্তি, প্রেম ও আনুগত্য; আবেগ ধর্মে জড়িত থাকে। ধর্ম ছাড়া মানব জীবনের অন্য কোন কিছু এতটা অতিপ্রাকৃত মহিমায় অভিষিক্ত নয় এবং ধর্মে প্রত্যাদেশের বিষয়টা অবধারিত। মানুষ ও তার স্রষ্টার সঙ্গে নিবিড় ঐক্য স্থাপন ধর্মের উদ্দেশ্য। (Lord Northbourne. Religion in the modern world, London, 1963, Paige-1-12)
ধর্মের রূপতাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় ধর্মবেত্তাগণ অনেক কিছু বলতে পারবেন, এ কথা সত্য, কিন্তু ধর্মকে মানুষের সত্যিকার কল্যাণে নিয়োজিত রাখা সত্যি কঠিন ব্যাপার। কারণ, মানব ইতিহাসে ধর্ম নিয়ে যথেচ্ছা বাড়াবাড়ির জন্য সর্বাধিক রক্তপাত ঘটেছে এবং বর্তমান যুগে বিশ্বব্যাপী যে হানাহানি চলছে তার অধিকাংশ প্রেরণা বোধ আসছে ধর্মীয় উগ্রতা থেকে। মানুষ কেন প্রার্থনা করবে, কীসের প্রার্থনা করবে? মানুষকে এই প্রশ্নের জবাব দেয় ধর্ম। ফলে, দুর্বলচিত্ত, অভাবগ্রস্ত মানুষের কাছে ধর্ম একটি প্রয়োজন, ঈশ্বর একটি অবধারিত সত্যের নাম। কিন্তু সামাজিকভাবে যারা অভাবমুক্ত. স্বাধীন ইচ্ছায় চালিত, তাদের কাছে অন্য কোন শক্তিতে আত্মনিবেদন তীব্র কোন প্রয়োজন নয়, একটি ফ্যাশন এবং সে কারণে ধর্মের বহিরাবরণটা তাদের চিন্তা ও চেতনার কাছে আকর্ষণীয়। এটা আমরা অস্বীকার করতে পারি না যে মানুষের অন্তর্গত ভাবনা-বেদনার প্রকাশ তার পরিবেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না; নিশ্চয় হয়, এবং হতে বাধ্য। যে সমাজে মানুষ প্রত্যক্ষ করে ধর্মভীরুদের ভণ্ডামী ও অত্যাচার ক্রমবর্ধমান, সেই সমাজ এক সময় ঈশ্বর ও ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। এবং প্রশ্ন তোলে সত্যি তাদের জন্য কোন ঈশ্বর আছে কিনা? অনেকে মনে করেন, ধর্মে মানুষের প্রার্থনা ও আনুগত্যের দাবিদার যে পবিত্র ঈশ্বরের কথা বলা হয়, তিনি আসলে সে রকম কোন ঈশ্বরই নন, বরং সমাজের মানুষের আনুগত্যের দাবিদার সমাজেরই প্রতিফলন। ব্যাক্তির চারপাশে যে সামাজিক সত্তা পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে সেটিই প্রতীকায়িত হয়েছে ঈশ্বর ও ধর্মের নামে। এটা সমাজ বিজ্ঞানীর দৃষ্টিভঙ্গি।
ধর্মকে কি ভয়ার্ত মানুষের অভিজ্ঞতা বলা যায়? ধর্মের কেন্দ্রিয় বক্তব্যে সব কিছু লয়-প্রলয়ের হুশিয়ারী আছে। যুক্তির শাশ্বত শৃঙ্খলার মধ্যে সত্যকে যাচাই করা যায় না। ক্ষুদ্র মোমবাতির আলো কখনো সূর্যের আলোকে যাচাই করার জন্য প্রতীক হিসেবে ব্যাবহার করা যায় না। সকল মানুষ অস্বিকার করুক তাদের স্রষ্টাকে, তবুও এই আকাশ, নক্ষত্রমন্ডল, সাগর-নদী ও পাহাড়সহ বিশ্বলোকের বৈচিত্র নিতান্ত উন্নাসিকের মনেও প্রশ্ন সৃষ্টি করে- নিশ্চয়ই এসবের একজন স্রষ্টা আছে। তাহলে ধর্ম সত্য। ধর্ম সত্য কেবল কিছু বিধি-বিধানের জন্য নয়, চিন্তাশীল মানুষের প্রজ্ঞাই সাক্ষ দেয়, অমরতার আকাংক্ষাই মানব জীবনে ধর্মের অস্তিত্বকে শাশ্বত করে তোলে। ধর্ম যুক্তির চেয়ে বিশ্বাসের পোষকতা করে বেশি। কারণ অদৃশ্য স্রষ্ট, ফেরেশতা, বেহেশত, দোযখ ও পরকাল সম্পর্কে নি:শংসয় বিশ্বাসই ধর্মেল মৌল ভিত্তি। এ গুলো বিশ্বাস করতে মানুষের যতই কষ্ট হোক-বিশেষত ইসলাম পালনের ক্ষেত্রে এগুলো বিশ্বাস না করে কোন উপায় নেই। এক্ষেত্রে মানব মনের আবেগ কাজ করে। মানুষের জীবনকে ঘিরে নেই অখন্ড সুখ, আছে অসংখ্য দু:খ কষ্ট; তাই দু:খ কষ্ট থেকে আছে পরিত্রাণ পাওয়ার উদগ্র আকাঙ্ক্ষা এবং সাধনা। ফলে ধর্মেল ভিত্ত্বি বিশ্বাস হলেও, মানবজীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে তাকে যুক্তির আলোয় পথ চলতে হয়। ব্যাক্তির আরাধনায় বিশ্বাসের প্রাধান্য থাকতে পারে, কিন্তু সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয় নীতিগত যুক্তির শৃঙ্খলার উপর। ধর্মেল লক্ষ্য একক কোন ব্যক্তিমানসের পরিবর্তন নয়, একটি বিশ্বাসী সমাজ প্রতিষ্ঠাই ধর্মের উদ্দেশ্য। ধর্মের পশ্চাতে এক মহান ব্যাক্তির ছায়া আছে, কিন্তু সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে জীবনের সার্বিক পরিবেশকে আশ্রয় করে। এ কারণে সংস্কৃতির বৈচিত্র্য লক্ষণীয় ব্যাপার। সংস্কৃতিকে আমরা নানাভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারি। সংস্কৃতির ইংরেজি শব্দ Culture এর অর্থ হল কর্ষণ করা বা চাষ করা। ব্যাপক অর্থে পরিশীলিত করা বা মার্জিত কিংবা সুন্দর করা।
ইউনেস্কো সম্মেলনে ১৯৮২ সনে সংস্কৃতির ব্যাখ্যায় বলা হয়, "ব্যাপক অর্থে সংস্কৃত একটি জাতির অথবা সামাজিক গোত্রের বিশিষ্টার্থক আত্মিক, বস্তুগত, বুদ্ধিগত এবং আবেগগত চিন্তা এবং কর্মধারার প্রকাশ। শিল্প ও সাহিত্যই সংস্কৃতির অন্তর্ভূক্ত একমাত্র বস্তু নয়, মানুষের জীবন ধারাও সংস্কৃতির অঙ্গ। মানুষের অধিকার , মূল্যবোধ, ঐতিহ্য এবং বিশ্বাসও সংস্কৃতির অঙ্গ"।
টেইলর বলেন, Culture is the complex whole which includes knowledge, belief, art, moral, low custom and any other capabilities and habits acquired by men as a member of society. আর্থৎ- সংস্কৃতি হল মানুষের অর্জিত জ্ঞান, বিশ্বাস, কথা, নীতিনিয়ম, সংস্কার ও অন্যান্য বিষয়ে দক্ষতার জটিল সমাবেশ।
সংস্কৃতি হল সুন্দরভাবে বাঁচা, পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হওয়া। সংস্কৃতি ও ধর্মের মধ্যে মোতাহার হোসেন চমৎকারভাবে পার্থক্য নিরূপণ করেছেন। সংস্কৃতি চায় জীবনকে বিকশিত করতে, কারণ সেটা জীবনের আর্ট। আর ধর্ম চায় জীবনকে পাপ থেকে, পতন থেকে রক্ষা করতে। কারণ ধর্মের পেছনে আছে একজন স্রষ্টা, সংস্কৃতির পেছনে আছে মানুষের জাগ্রত চেতনা। তাই ধর্মের মৌলিক নীতির বদল ঘটে না। কিন্তু সংস্কৃতির রূপান্তর ঘটে। যেমন শিল্পের মধ্যে শিল্পীর ব্যাক্তিত্ব বিভিন্ন যুগের প্রভাবে বিভিন্ন মাত্রায় বিকশিত হয়।
জাতি হয়ে উঠার জন্য ঐতিহ্যের বিকল্প নেই। আর ঐতিহ্যই সংস্কৃতির কেন্দ্রভূমির রচয়িতা। একটি সমাজ বা জাতিকে দূর থেকে চেনা যায় তার সংস্কৃতির জন্য। ধর্মীয় বিশ্বাসে আমরা ৫৭টি দেশের সব নাগরিক মুসলমান; কিন্তু জাতিগতভাবে সংস্কৃতির পার্থক্যের জন্যই আমরা কতটা স্বতন্ত্র! আবার এ কথাও আমরা বলতে পারি, পৃথিবীর সকল প্রকার সংস্কৃতি মানবজাতির ঐতিহ্য। একটি জাতির সার্বভৌমত্ব স্বাধীনতা এবং অভিজ্ঞান সংস্কৃতির মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। সংস্কৃতির পরিশীলিত চর্চার মাধ্যমে আত্মিক, মানবিক এবং পার্থিব ইচ্ছার বিকাশ ঘটে। একথা সত্য, ব্যাক্তির সাংস্কৃতিক বোধ পরিবার থেকে, পারিবারিক ও সংস্কৃতিক মান আসে সমাজ থেকে ও সমাজের সাংস্কৃতিক পরিচয় আসে জাতি থেকে।
ইসলাম একটি ধর্ম, সে ধর্ম মানুষের জন্য দিয়েছে একটি জীবন ব্যবস্থা। সেই জীবন ব্যবস্থার আঙ্গিকের মধ্যেই যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, সেটাকে আমরা ইসলামী সংস্কৃতি বলতে পারি। ইসলাম প্রদর্শিত জীবনের গতিপথ-সরল, কিন্তু কঠোর। কঠোর এ কারণে যে, চোখের সামনে এতীমের সম্পদ থাকবে, ভোগ করা যাবে না, যে আল্লাহকে দেখা যায় না, তাকে খাটি মনে মৃত্যু পর্যন্ত পতিদিন পাঁচবার নামাযের মাধ্যমে ডাকতে হবে, কঠোর ভাবে নৈতিকতা বজায় রাখতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। আধুনিক কালে চারপাশে লোভ লালসা ছড়িয়ে থাকা মানুষের জন্য এগুলো নিশ্চয়ই কঠিন। এ কারণে ইসলামী জীবনের সংস্কৃতিটা উচ্ছৃঙ্খল জীবনের নয়, সম্পূর্ণ যুক্তিপূর্ণ এবং ব্যাতিক্রমী। ইসলামী শরীয়া মুসলমানদের জন্য যে আইন রচনা করেছে, ইসলামী সংস্কৃতির ভিত্তি সেটাই। এর বাইরে যা কিছু আছে বা ঘটবে, ইসলামের নামে সেটা মূলত সাধারণ সংস্কৃতি যার শেকড় আরব-অনারব জাতিগোষ্ঠির নিজস্ব ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গভীরে প্রোথিত। একটি বিষয় আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, আরব ভূ-খন্ডে ইসলাম প্রতিষ্ঠালগ্নে, আল্লাহ অতীতের যে সকল অনাচার ও কুসংস্কৃতি বাতিল করে দিয়েছেন, কোন অজুহাতে, বিশ্বের কোন দেশে কখনো সে ধরনের কোন আচার-অভ্যাস ইসলামের ভেতরে যাতে প্রবেশ করতে না পারে সে বিষয়ে সতর্ক থাকা আবশ্যক। যেমন যে পৌত্তলিকতা উচ্ছেদ করে ইসলামের প্রতিষ্ঠা, সেই পৌত্তলিক মানসিকতা নতুনভাবে ভিন্নরূপে বা আঙ্গিকে যদি ইসলামের মধ্যে প্রবেশ করে তাহলে বুঝতে হবে; আমরা ইসলামের পবিত্রতা রক্ষায় সম্পূর্ণ ব্যার্থ। আমরা জানি, প্রত্যেক জাতির বাপ-দাদাকালীন কিছু সংস্কার বা প্রথা চলে আসছে, যা ত্যাগ করে আসা একটি কঠিন কাজ। বিশ্বের সকল মুসলমানদের মধ্যে এক মাস রোযা পালন, বছরে দু'বার ঈদ উদযাপন কিংবা সামর্থবানদের হজ্জ্ব পালন এ সব ধর্মীয় বিধি-বিধান পালনে সাদৃশ্য থাকলেও বিভিন্ন জাতির মধ্যে চিন্তা চেতনায়, জীবনাচারে যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান এবং সেটাকে আমরা প্রত্যেক ব্যাক্তির নিজস্ব সাংস্কৃতিক ও উত্তরাধিকারের মধ্যে পার্থক্য বলে মনে করি। একজন ভারতীয় মুসলমান এবং একজন আরবীয় মুসলমানদের মধ্যে ধর্মবোধে পার্থক্য নেই। কারণ তারা উভয়ে ইসলামের অনুসারী; কিন্তু তাদের জীবন ভাবনা ও সামাজিক আচারে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। যেহেতু একজন জাতিতে আর্য, অন্যজন সেমেটিক। আফ্রিকার সুদান বা নাইজেরিয়ার মুসলমানের সঙ্গে একজন কাজাক বা তাতার মুসলমানের সঙ্গে পার্থক্য ঠিক একই কারণে বিদ্যমান। কারণ একজন নিগ্রোয়েড অন্যজন ইউরোপিয়েড। একজন কে বাস করতে হয় মরুর লু হাওয়ার উষ্ণতার মধ্যে, অন্যজনকে সাইবেরিয়ার শীতল হাওয়া থেকে রক্ষার জন্য পড়তে হয় ভেড়ার লোমের তৈরী গরম পোশাক।
আমরা মনে করি, শিল্প সাহিত্য ও সঙ্গীত সাধারণ সংস্কৃতি। কিন্তু না, এ গুলো হল সংস্কৃতির বাহন। সংস্কৃতি একটি চেতনা, মৌলিকবাবে একটি জীবন চেতনা। আবার এই চেতনা ছড়িয়ে থাকে গৃহ নির্মানে, পোশাক পরিচ্ছেদ, আসবাব পত্রে, শিক্ষায়, শিল্পে-সাহিত্যে এবং অর্থনীতি ও রাজনীতিতে; এমনকি পুরোহিতের বিয়ে অনুষ্ঠানের মন্ত্রপাঠেও। এ কারণে আমরা একজন মানুষকে জোর করে অন্যজনের মত ও মতবাদ গ্রহনে বাধ্য করতে পারি না। মানুষ নদী ভাঙ্গনে ঘরবাড়ী হারালে পুন:নির্মান করে নেয়; কিন্তু সে তার ধর্ম ও সংস্কৃতি হারালে তার কিছুই থাকে না। আমরা বাঙালি মুসলমান, পায়জামা-পান্জাবী এবং শাড়ী পরায় অভ্যস্ত, আমরা তুর্কীদের মতো মাথায় হ্যাট ও প্যান্ট পরে আরামবোধ করব না। যদিও আমরা উভয়ে এক ধর্মাবলম্বী। বাঙালীদের জারী গানের আসর আর রাশিয়ানদের বল ড্যান্স, পশ্চিম ইউরোপের নাইট ক্লাব সংস্কৃতি আর আফ্রিকানদের উদাম দেহে রং মাখা নৃত্য-কখনো কি তাদের জীবনাচার থেকে মুছে ফেলা যাবে? আমরা এটা অকাট্য বলে করতে পারি না যে, সংস্কৃতির রূপান্তর ঘটে না। আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন মানুষের জীবনপদ্ধতিতে যখন মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে আসে, নতুন উদ্ধুত পরিবেশে মানুষ তার সংস্কৃতির মধ্যেও কিছু পরিবর্তন কে মেনে নেয়। ঊনিশ শতকীয় কলকাতায় নব্য বাবু শ্রেণীর উদ্ভব এবং একুশ শতকের ঢাকায় গুলশান-বনানী-ধানমন্ডি-উত্তরার উচ্ছৃঙ্খল তারুণ্যস্রোত- হঠাৎ অর্থে বিত্তে শক্তিমান এক অমিতাচার শ্রেণীর উত্থান বাঙালীর ঐতিহ্য বিরোধী হলেও, যুগের ফসল হিসেবে এ সমাজেরই একটি অংশ হওয়ার দাবিদার।
সাম্রাজ্যবাদ কিভাবে জাতি-উপজাতির মৌলিক শিক্ষা ও সংস্কৃতি ধ্বংস করছে, তা কেবল ভয়াবহ যুদ্ধের প্রত্যক্ষ পরিণাম হিসেবে দেখছি না; তা নিরন্তর ঘটে চলছে স্বাভাবিক শাসন প্রক্রিয়ার মাধ্যমেও। কিপলিং এর একটি গল্পে, দার্জিলিং এর পাহাড়ী এলাকার কাছাকাছি একটি বাংলোতে এক বৃটিশ পরিবার বাস করত। ইংরেজ মহিলা বাসার কাজের জন্য স্থানীয় এক উপজাতি-মেয়েকে রেখেছেন। দীর্ঘদিন মেয়েটি বাসায় দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে। ইংরেজ মহিলার দূর সম্পর্কীয় এক ভাই ইংল্যান্ড থেকে ভারতবর্ষ ভ্রমনে এসে মাস তিনেক তার বাসায় থাকল। ভদ্রলোক অবিবাহিত এবং শিক্ষিত; উপজাতীয় কাজের মেয়ের সঙ্গে তার প্রেম সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং সে মেয়েটিকে কথা দেয় তাকে বিয়ে করে বৃটেন নিয়ে যাবে। বিষয়টি গৃহকর্তী জানল এবং মেয়েটিকে ইংরেজদের মত চলা, কথা বলা, প্যান্ট পড়া থেকে শুরু করে অনেক কিছু শেখালেন; এবং মেয়েটা ভালবাসার টানে ঘরের কাজে আরো মনোযোগ দিল। ভদ্রলোক একদিন বলল, আমি ইংল্যান্ড যাচ্ছি, বাবা-মাকে নিয়ে আসব, শীঘ্রই এসে তোমাকে বিয়ে করব। মেয়েটা ঘাড় নেড়ে সম্মতি দেয় এবং তাকে শেষ বিদায় আলিঙ্গন করে। ভদ্রলোক ইংল্যান্ডে গেলেন প্রায় একমাস, মেয়েটা তার কথা মনে করে এবং উৎসাহের সঙ্গে ঘরের কাজ গুছিয়ে রাখে, ইংরেজ মহিলার ফাই-ফরমায়েশ খাটে। মাঝে মাঝে গৃহকর্তীকে ঐ লোকটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে, মহিলা বলেন, এই তো আসবে, এ মাসে না হলেও, আগামী মাসে বাবা-মা কে বুঝিয়ে আনবে, তারপর তো; তুমি নিশ্চন্ত থাক। এভাবে তিনমাস অপেক্ষার পর মেয়েটা সত্যি যখন বুঝতে পারল, সে একটি প্রতারণার শিকার হয়েছে, তখনই সে তার মাথার ব্যান্ড, প্যান্ট-শার্ট, রাত্রিবাসসহ ইংরেজ মহিলার দেয়া সব কিছু খুলে রেখে যে পোশাক পড়ে সে প্রথম এ বাড়ীতে এসেছিল, সেই ঢিলা ব্লাউজ, আর লুঙ্গির মত কাপড়টা পড়ল, মাথার চুল আবার বেনী করে বাঁধল, পায়ের জুতাটাও খুলে রাখল এবং সে ইংরেজ মহিলার সামনে গিয়ে আদিম উপজাতিয় হয়ে দাঁড়াল, লিপিষ্টিকহীন ঠোটে সাদামাটা অথচ কাঁটাকাঁটা উচ্চারণে বলল, আমি যাই। 'তুমি কোথায় যাচ্ছ? তোমার এ অবস্থা কেন? ইংরেজ মহিলার প্রশ্ন। আপনার কোন কিছু আমি নেইনি, সব কিছু পাকঘরের মেঝের ওপর রইল, আমি যাচ্ছি আমার আর ফেরা হবে না। 'এসব কি বলল তুমি?'
আমি আর এখানে আসব না, আপনি অন্য মেয়ে খোঁজ করুন, বলে মেয়েটি এক দৌঁড়ে তার সম্প্রদায়ের সঙ্গে গিয়ে মিশল। ইংরেজ মহিলা দূর থেকে তাকিয়ে দেখল সে তার পীঠের ওপর বেণী দুলিয়ে দৌঁড়ে যাচ্ছে যেমন অন্য উপজাতীয় মেয়েরা দৌঁড়ায়।
সাম্রাজ্যবাদ প্রতারণা ও কুটিলতার শিক্ষা দিয়েছে কিন্তু প্রকৃতির কোল লগ্ন উপজাতির মধ্যে সরলভাবে বিশ্বাস এখনো অটুট। সত্যতা তারা হয়ত গ্রহণ করে না সরলতা বিনষ্টের আশংকায়। আমরা ঐ উপজাতি মেয়েটির মত, ইংরেজদের দুশোবছরের শাসন শোষণ মেনে নিয়েছি, কিন্তু সংস্কৃতি গহণ করিনি। কারণ ওরা বণিক, ওরা কপট, ওরা হিংস্র।
সংস্কৃতি যদি হয় সুন্দরভাবে বাঁচার অনন্য প্রেরণা; ইসলাম তাহলে সেই প্রেরণার মৌলিক উৎস। অনেক ব্যাখ্যাকার বলেছেন, ধর্ম সংস্কৃতির উপাদান। আমরা বলব, ধর্ম সংস্কৃতির উৎস। ইসলাম কেবল ইহকালের জীবনে সুন্দরভাবে বাচার প্রেরণা যোগায় না, সে পরকালের জীবনেও নিরাপত্তার কৌশল শিক্ষা দেয়। ইসলামী সংস্কৃতির মূল প্রোথত হল, দর্শনগত দিক থেকে, বিশ্বাসী মানুষের অন্তরে। মুসলমানদের সকল কর্মনীতি নির্ভর করবে তার খোদায়ী অস্তিত্বে দৃঢ় বিশ্বাস রাখার উপর। যার মধ্যে অদৃশ্য বিষয়ে বিশ্বাস নেই তার কাছে ইসলাম কিছুই আশা করে না। যদি একজন অতিথিকে আপ্যায়নের পদ্ধতির মধ্যে সংস্কৃতির প্রকাশ পায়, তাহলে বুঝতে হবে, খাবার পরিবেশনের পদ্ধতিটা হল সংস্কৃতি; কিন্তু অতিথি যদি নাই আসে, খাবার পদ্ধতি রচনার প্রশ্ন উঠে না। ইসলামে একাত্মবাদে বিশ্বাস যেমন মৌলিক বিষয়, ইসলামের জীবন রক্ষা করার জন্য শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ করাও তেমনি অনিবার্য ব্যাপার। জিহাদও ইসলামী সংস্কৃতির অন্যতম বিষয়। সাধারণভাবে প্রকৃতির আঘাত থেকে রক্ষা করা যেমন কর্তব্য, তেমনি অবিশ্বাসীদের আক্রমন থেকে আত্মরক্ষার জন্য যুদ্ধ করা দায়িত্ব। সেই সঙ্গে কোরআন ও হাদীসের আলোকে জীবনকে সুশৃঙ্খল করাও সংস্কৃতির অঙ্গ। আবার এও মনে রাখতে হবে, মানুষ শুধু চব্বিশ ঘন্টা ধর্ম কর্ম নিয়ে পড়ে থাকবে, তা হয় না; সময়কে উপভোগ করার জন্য তাকে শিল্প চর্চা করার প্রয়োজনও হয়। ড:সাইয়েদা ফাতেমা সিদ্দীকা বলেন, A Culture is a code of life, to be more precise a code of human conduct for the development of human life and ideal. যেহেতু কোরআন পরিপূর্ণ একটি শান্তিময় জীবন বিধান, সেহেতু কোরআন এর অনুগত জীবন যাপনই ইসলামী সংস্কৃতিকে সম্পূর্ণতা দিতে পারে। কোন অজুহাতে ইসলামের সংস্কৃতি পরিপন্থী জীবন যাপন করার অর্থ হল ইসলামের মূল শক্তিকে ধ্বংস করা এবং মুসলিম মিল্লাতকে পঙ্গু করা।
পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রভাবে যারা মুসলিম সমাজে বাস করেও, অপসংস্কৃতির চর্চা করছে, তারা এ জাতির পুনর্গঠনের সময় আত্মত্যাগে আগ্রহী হবে না, বরং বিরোধীতা করবে। অহেতুক অর্থ ও কৌলিন্যের অহংকারে তারা যথেচ্ছা জীবনাচারে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। তারা ভূঁইফোড় একটি বিচ্ছিন্ন জনতায় পরিণত হয়েছে। অথচ তাদের বোঝা উচিত, ইসলাম কে পরিপূর্ণ করার জন্য নতুন কোন বিধি-বিধান সংযোজনের প্রয়োজন নেই। জীবনকে অবসরে উপভোগ করার জন্য পাশ্চাত্য দুনিয়া যে সব উপায় উদ্ভাবন করেছে, তা প্রধানত নারী ও মদের রকমারী ব্যবহার বলতে হয় এবং সেখানে মানব মনের নান্দনিক তৃষ্ণা মেটানেরা পরিবর্তে, দৈহিক কামনা বাসনাই বেশি প্রাধান্য পায়। সে কারণে পাশ্চাত্যের অনুকরণে এদেশে ছবি-ছিনেমার বিস্তার ঘটছে, সেগুলো নগ্ন যৌন আবেদনে পরিপূর্ণ। এটা মৌলিকভাবে ইসলামের নৈতিকতা বর্জিত, শয়তানি কর্মকান্ড। যেহেতু নারী ও মদ যখন একত্র হবে, তখন অবশ্যই সেখানে অপকর্ম প্রাধান্য পাবে এবং ভোগ বিলাসিতার মধ্যে মনকে বন্দী করে ফেলবে। নারী মোহ সৃষ্টি করে, মদ জাগিয়ে দেয় উত্তেজনা। তারপর চর্চা হয় পাপের। এগুলোই হচ্ছে আধুনিক পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রধান উপকরণ এবং সেগুলোর ঢেউ এখন আছড়ে পড়ছে তৃতীয় বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোতে।
দেশের ইসলামপ্রেমী চিন্তাবিদগণ, অপসংস্কৃতির ক্রমবর্ধমান জোয়ারে আতঙ্কিত। প্রতিরোধের জন্য চলছে ব্যাপক ওয়াজ মাহফিল এবং ঈমানদ্বারদের মনে পরকালীন ভয় ধরিয়ে দেয়ার মত কাহিনী পরিবেশিত হচ্ছে। ইসলামী জীবনকে কিভাবে রক্ষা করা যায়, এ চিন্তা সকলের; কিন্তু কার্যকর উপায় পাওয়া যাচ্ছে না। প্রত্যক্ষ পরাধীনতার চেয়েও ভয়ংকর এই অপসংস্কৃতির আক্রমণ। ক্ষেপনাস্ত্র মধ্য আকাশে প্রতিরোধ করা যায়; কিন্তু সাংস্কৃতিক আক্রমণ প্রতিরোধের ব্যবস্থা কি? ইসলামের নিজস্ব সংস্কৃতি বলতে কি কিছুই থাকবে না?
আধুনিক ইউরোপিয় বিজ্ঞান যেমন গোটা বিশ্বকে অধম দাসে পরিণত করেছে, তেমনি তাদের সংস্কৃতিও কি সকল জাতির জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে যাবে? যদি তাই হয়, তাহলে বিশ্ব সভ্যতা বলতে কি থাকবে? বৈচিত্র ও বিভাজন, যা প্রত্যেকটি জাতির প্রাতিস্বীকতায় ওজ্জ্বল্য-তা হারিয়ে গেলে বিশ্ব পরিচয়ের কি থাকবে? যুক্তি ও বিজ্ঞান মিলে ইউরোপিয় সংস্কৃতি যা বস্তুবাদী বা একেবারে পার্থিবমুখী জীবনযাপনের নেশা জাগিয়ে দেয়, সেটাই যদি হয় দৈনন্দিন জীবনাচারের নিয়ন্ত্রক, তাহলে আমরা যে পারিত্রিক জীবনের কল্যাণ প্রত্যাশী তা কিভাবে অর্জিত হবে? ইউরোপীয় জীবন-সংস্কৃতির নগ্নতাটুকু বাদ দিলে, বাকীটা তো অস্বীকার করা যায় না। কারণ সেটার একটা দৃঢ় ভিত্তি তারা দিয়েছে। সেটা হল ইহ জাগতিক অস্তিত্ববাদ এবং বিজ্ঞানবাদ। যদিও এ দুটোই তারা নিয়েছে, অষ্টম থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত বিকশিত মুসলিম দর্শন ও সংস্কৃতির প্রেরণা থেকে। পরবর্তিতে এর সঙ্গে তারা যুক্ত করেছে বিশ্বজয়ের নেশা, যা মুসলিমরা করেনি।
বর্তমান যুগে, মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শক্তিহীন, পরাজিত মুসলিম বিশ্ব এখন একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মধ্যে বন্দী এবং আহত অবস্থায় খাবি খাচ্ছে। সেই সঙ্গে সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির দিকে তাকালে দু:খ বোধের করুন ছায়া এসে পড়বে আমাদের মলিন মুখে। বিশ্বের রাজনৈতিক শক্তি হারিয়ে মুসলমানরা এখন সাংস্কৃতিক পরাজয়টাকে হজম করছে। যে সব বিষয় নিয়ে তারা পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে দাড়াতে চাচ্ছে, তা চাপদাড়ি ভরা মুখ গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসা ব্যথ আসফালনের অহেতুক উচ্ছ্বাস ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ কোরআন যে আইনের শাসনের কথা বলে, মুসলমানরা সেটা অনেক আগেই ত্যাগ করেছে। জনৈক নাস্তিকের ভাষায়, যাদের দাড়িতে সত্তর হাজার ফেরেশতা বাস করে তাদেরকে আবার ময়দানে গিয়ে যুদ্ধ করতে হয় নাকি? নবীর (স:) সুন্নতের দিকে এরা এত বেশী জোর দিয়েছেন যে ঘন ঘন তাবলিগে যাচ্ছে কিন্তু পবিত্র কোরআনে আসলে কি আছে তা মাতৃভাষায় পাঠ করার প্রয়োজনও বোধ করছে না। বেদও হিন্দুদের ধর্ম গ্রন্থ, কঠিন সংস্কৃত ভাষায় রচিত; শতকরা ৯৮% জন হিন্দ বেদ-এর নাম শুনেছে, চার খন্ড বেদ তাও শুনেছে কিন্তু পড়েনি, অনেকেই কেবল উপনিষদ দিয়ে কাজ চালায় ব্রাক্ষাণ শ্রেণী আর মনু-সংহিতার শ্লোক নিয়ে ধর্মচর্চা করে বৈশ্য-শূদ্র। এই হচ্ছে হিন্দু ধর্মের হাল অবস্থা। আর মুসলমানরা পাঠ করে বোঝার চেয়ে শুনে বলার ওস্তাদ; অবশ্য দোষ তাদের নয়, দোষ সিরাজ-উদ-দৌলার; কেন সে পরাজিত হয়ে দেশটা ইংরেজদের হাতে দেয়ে গেল, নইলে ঐতিহাসিকভাবে বাঙালী মুসলমানরা নিরক্ষর থাকত ?
বস্তুতপক্ষে, দোষ আমরা যাকেই দেই না কেন, আমেরিকা আমাদের জন্য যে রোডম্যাপ করে দিয়েছে, তা দেখে দেখে চলতে হবে এবং সেটা আগামী কয়েকশ বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল নিয়ে অপেক্ষা করছে।
ইসলামের সংস্কৃতির মধ্যে আমাদের অনিবার্য জীবন। যেহেতু আল্লাহ বলেন, "ইসলামকে বাদ দিয়ে কেহ অন্য কোন মতাদর্শকে দ্বীন বা জীবন ব্যবস্থা গ্রহণ করলে, তা কখনো গ্রহণযোগ্য হবে না। আর আখেরাতে তারা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভূক্ত থাকবে। "( আল-ইমরান : ৮৫)
কিন্তু প্রশ্ন হল, আল্লাহ আমাদের মধ্যে যে রুপ দেখতে আগ্রহী, আমরা কি সেই রূপের সার্থক চর্চা করতে পারছি? ইসলাম ও মুসলমানদের সংকট কিন্তু এখানেই। বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে মুসলিম সংস্কৃতির একটি সর্বগ্রাসী রূপ আছে। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞানচর্চার মহাপুরুষীয় আহ্বান আরব মনীষীরা বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলে ইসলামী জীবন ও সংস্কৃতিকে অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্ব সভ্যতার একটি বিশেষ অংশে তারা পরিণত করতে পেরেছিলেন। আমরা ইসলামী সংস্কৃতির রূপরেখা অঙ্কন করতে গেলে প্রথমে যেতে হয় কোরআনের অমর বণীসমূহের কাছে যার ভেতর তেকে ইসলামী জীবনের শাশ্বত বুনিয়াদ গড়ে উঠেছে।
"তোমরা আল্লাহ ছাড়া কারো উপাসনা করবে না, পিতা-মাতা আত্মীয়-স্বজন, এতীম ও দ্বীন-দরিদ্রের সাথে সদ্ব্যবহার করবে, মানুষকে সৎ কথাবার্তা বলবে, নামায প্রতিষ্ঠা করবে, এবং যাকাত দিবে। (আল-বাকারা:৮৩)
ইসলামী জীবনের কর্মকান্ড লিখে যে সংস্কৃতিটা গড়ে উঠেছে তা আল্লাহর কাছে সতত দায়বদ্ধ। কারণ অহেতুক হাসি ঠাট্টা গালগপ্প করে সময় নষ্ট করার অবকাশ ইসলামে নেই। যদি তা হত আল্লাহ প্রশ্ন করতেন না, 'তোমরা হাসছ, ক্রন্দন করছ না? কিসে তোমাকে গাফেল রেখেছে? স্ত্রী-পুত্র পরিজন, অর্থ সম্পদ এবং কিছু ক্ষমতা, এ ছাড়া মানুষের অহংকার করার কি আছে? অন্তরে আল্লাহর স্থান না দিয়ে মানুষ পার্থিব সুখ-সুবিধার জন্য যা কিছু করছে তাই ইসলামী জীবনের বিপরীত, তা ইসলামী সংস্কৃতির মধ্যে গণ্য নয়। পূর্ব-পশ্চিমে সিজদা করাও ইসলামের নির্দেশ নয়; তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত করা এবং সৎকার্যসমূহের প্রতি একনিষ্ঠ থাকাই ইসলামী জীবনের অঙ্গীকার।
মানব জীবনের কিছু মৌলিক বিষয়ের ওপর ইসলামী বিধান প্রতিষ্ঠিত যা তার সাংস্কৃতিক পরিচয়কে স্বাতন্ত্র্যমন্ডিত করে। যে মৃত্যকে সুদূর পরাহত একটি বিষয় বলে মনে হয়, সেটা যে কোন মুহুর্তে এসে আমাদের প্রাণবায়ু ছিনিয়ে নিতে পারে; অত:পর আল্লাহর প্রতিশ্রুত পরোকালের আশ্বাদ গ্রহণ করতে হবে, আমাদের পার্থিব কর্মফলের ভিত্তিতে। এর মত, জীবনে আর কোন স্থায়ী মৌলিক সমস্যা কিন্তু নেই। এজন্য আল্লাহ নবীর (স:) মাধ্যমে বলেন, "তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ উত্তম বিষয়ের অনুসরণ কর, তোমাদের কাছে অতর্কিতে ও অজ্ঞাতসারে আযাব আসার পূর্বেই। যাতে কেউ না বলে, হায়! আল্লাহর সকাশে আমি কর্তব্যে অবহেলা করেছি এবং আমি ঠাট্টা-বিদ্রুপকারীদের অন্তর্ভূক্ত ছিলাম। (আল-যুমার : ৫৫-৫৬)
ইসলামের সংস্কৃতি তার আইনসংগত ব্যবহারের মধ্যে। আল্লাহর প্রতি আত্মনিবেদন যেমন অপরিহার্য, মানুষের প্রতি ন্যায়সঙ্গত বিচার মিমাংসা করাও তেমনি। মানুষের ইনসাফ বা ন্যায়বিচার মানুষের প্রার্থনাকে যথার্থতা দান করে। "মুমিনগণ! যদি কোন পাপাচারী ব্যক্তি তোমদের কাছে কোন সংবাদ আনয়ন করে, তবে তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখবে, যাতে অজ্ঞতাবশত, তোমরা কোন সম্প্রদায়ের ক্ষতিসাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত না হও (আল-হুজরাত : ০৬)। প্রকৃতপক্ষে অত্যন্ত হিসেবি একটা জীবন ব্যাবস্থা ইসলাম তার অনুসারীদের দান করেছে। For 24 hours, the followers Islam should be alert about their duties and aware of surroundings. কেবল শয়তান সময় নষ্ট করে এবং বিভ্রান্তদের সময় নষ্টের দিকে কুমন্ত্রনা দেয়। নর্তকীর নাচ, বাইজির ড্যান্স, সাকীর শুরা, ভন্ডের জুয়াখেলা আর কুরুচিশীলদের লালসার জন্য যে কৌতুকপূর্ণ সময় অপচয় হয়, একজন জ্ঞাণীব্যক্তি, যিনি বিশ্বাস করেন এ গুলো অর্থহীন উল্লাস, মৃত্যু সন্নিকটে, তিনি সেই অপচয় মেনে নেবেন না। মানুষকে পার্থিব জীবনে যা ক্ষতি করছে তা হলো তার মজ্জাগত অলসতা। অথচ কোরআনে আল্লাহ স্পষ্ট বলেন, নামাজের পর তোমরা বেরিয়ে পড়। অর্থাৎ পার্থিব জীবনে আয় উন্নতির জন্য ন্যায় সঙ্গত পথে পরিশ্রমের জন্য আল্লাহর নির্দেশ। এটা ইসলামী জীবনে সংস্কৃতির একটি বিশেষ দিক।
ইসলাম একটি জ্ঞানাত্মক ধর্ম। প্রত্যাদেশ এবং বাস্তববীক্ষণ এর প্রেরণাশক্তি। সত্যানুসন্ধান এর চরিত্রনীতি; কোরআনিক বিধানের মধ্যে থেকে সৃষ্টিকর্তার ইবাদত ও পার্থিব জীবনকে পরিপাটি করা এর সংস্কৃতি। মানব জীবনকে ঘিরে থাকা সকল অমঙ্গল বোধের বিরুদ্ধে এর লড়াই ও অঙ্গীকার। মানুষের অবরুদ্ধ চেতনার মুক্তির জন্য ইসলাম পর্যবেক্ষণশীল যে দৃষ্টান্তগুলো উপস্থাপন করছে, তা নিছক কতগুলো ঘটনার প্রতিবেদন নয়। বিশ্বপ্রকৃতির গঠনশৈলী ও মানুষের গঠন বিন্যাসকে সামনে রেখে কোরআন যখন মানুষের কাঝে এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের আহ্বান জানায় তখন জ্ঞান সাপেক্ষে উপলব্ধির সূক্ষ্ম চেতনা দিয়ে মানুষ বিশ্বাস করতে অনুপ্রাণিত হয়। এই বিশ্বাসকে পদদলিত করে দেহজ কামনা নানা আঙিকে শির-শিরিয়ে উঠার নাম কি ইসলামী সংস্কৃতি যা বর্তমান সমাজে চলছে?
ইসলামের জীবনবোধ আত্মপবিত্রতার সঙ্গে যুক্ত যেমন শিল্পীর শিল্পবোধ তার তুলি ও রংয়ের সঙ্গে যুক্ত। মানুষের কামজর্জর-লোভাতুর আত্মাকে পবিত্র করার মহৎ উদ্দেশ্যকে খাটো করে ইসলাম কি সুন্দর হতে পারে? অথবা এর সংস্কৃতি? অথচ এ যুগে ইসলামের একটা দিক, সেক্যুলারিজমের আসবাবপত্রের মধ্যে আটকে গেছে। মাঝখানে লক্ষ লক্ষ মুসল্লির ইসলাম কেবল নামাজ ও রোজার মধ্যে এমনভাবে উদযাপিত হচ্ছে যে, মানুষের প্রতি ন্যায়পরায়ণ হওয়া বা অত্যাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর কোন দায়িত্ব নেই। শরীয়া অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে তরবারী তুলে ধরার মুসলমান কি আছে? যারা আছে তারা যে সব নামাজী ও রোযাদার! ইসলাম আসলে এখন পঙ্গু অক্ষমদের আত্মায় কিছুটা শান্তিদানের ধর্মে পরিণত হয়েছে। অসৎ ব্যাবসায়ীর কব্জি কাটার সাহস কার, কেইবা সে দায়িত্ব পালন করবে? যদিও আল্লাহ নিশ্চয়ই ন্যায়পরায়নতা এবং ইহছান-পরোপকারিতা এবং আত্মীয় স্বজনদেরকে দেবার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন এবং তিনি অনিষ্ট ও বিদ্রোহ নিষেধ করেছেন।
ইসলামের মত একটি বৈজ্ঞানিক ও গতিশীল ধর্মের মধ্যে যুগের আবর্জনা জড়িয়ে পড়ার ঐতিহাসিক প্রেক্ষিততো আমাদের জানা উচিত। বৃটিশরা আমাদের আধুনিক বোধ দিয়েছে, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে ইসলামের বিপ্লবী চেতনা। সত্যিকার জীবনের আলো ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা তারা নি:শেষ করে দিয়েছে। শুধু সামাজিক কাঠামো ভাঙ্গেনি, মুসলিম জাতির আত্মার মধ্যে পার্থিব জীবন নেশার অসুখ ঢুকিয়ে দিয়েছে। ফলে পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি অনুসরণ করতে এখন মুসলমানদের অভক্তি জাগে না। মৃত আত্মাগুলোর মধ্যে কলের গাণের মত জিকির শোনা যায়। অসততার মধ্যে, মুসলমানরা ক্রমবর্ধমান জীবনের সার্থকতা সন্ধান করছে যা কখনো সফল হবার নয়।
মুসলিম সংস্কৃতি আজ কতকগুলো প্রথার মধ্যে নির্জীবভাবে পালিত হচ্ছে; কিভাবে তাকে একটি জীবন্ত সত্তায় ফিরিয়ে আনা যায়, সেটা ভেবে দেখার সময় এসেছে। একটি জাতি যখন যুদ্ধে জয়ী হয় অনেক রক্তের বিনিময়ে, তখন সে জাতি কেবল যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে না, সে ভবিষ্যতে যে কোন বিপদে ঐক্যবদ্ধ থাকার অজেয় সম্ভাবনাও নিজের মধ্যে আবিষ্কার করে। এই অসম্ভব শক্তির আবিষ্কৃতির জন্য একটি জাতিকে প্রচুর ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, অন্যথায় জানা যায় না, একটি জাতি সত্যি কত বড় এক মহান জাতিতে পরিণত হতে পারে।
শান্তশীতল স্রোতধারার মধ্যে অবগাহন করে কখনো যেমন টের পাওয়া যায়না, ভুমিকম্প, ঝড় আর টাইফুন ও জলবায়ুর বৈশিষ্ট, তেমনি শুধু রুটিন মাফিক দু-বেলা খেয়ে পরে বোঝা যায় না জীবনে আঘাত ও দু:খ, বিপর্যয় ও হতাশও আছে। ভাঙ্গাগড়ার নিবিড় ঐক্যে মানব জীবন গঠিত। আমরা যা নিয়ে সুখে থাকতে চাই, তা হয়তো মখমলের তাকিয়ায় হেলান দিয়ে আরামে খাওয়া পরা; কিন্তু মানুষের জীবন কি তাই? ইসলামের সংস্কৃতি কি তাই বলে? কোরআনে আল্লাহ স্পষ্ট ঘোষনা করেছেন, 'হে মানুষ, কষ্ট স্বীকার করে অবশ্যই তোমার প্রভুর দরবারে পৌঁছাতে হবে" আমরা শত শত বছরের মানবীয় ইতিহাস পর্যালোচনা করে এ সত্যের প্রমাণ পাই; পৃথিবীতে যে গৌরবময় সভ্যতার বিকাশ দেখা যায় তার পেছনে রয়েছে মানুষের ক্লান্তিহীন পরিশ্রম। ভাবগত ও বস্তুগত উন্নতির পথে কায়িক ও মানসিক পরিশ্রমের কোন বিকল্প নেই। ইসলামের প্রতিষ্ঠাকালীন যুদ্ধে সাহাবীদের নির্ভীক সাহসিকতা যে গৌরবময় ইতিহাস রচনা করেছে, তা ইসলামের ধর্ম-সংস্কৃতি ও সভ্যতার এক অতুলনীয় উপার্জন। সেই যুদ্ধগুলোই আমাদের প্রেরণা।
আলোচনার শেষ প্রান্তে আমরা ধর্ম-সংস্কৃতি ও ইসলামকে ঘিরে আর যে কথাটি বলতে চাই, সেটা হল, ধর্ম ভাববাদের বিষয় হিসেবে আধ্যাত্মিকাতার মধ্যে সীমাবদ্ধ কিছু অনুভাবনা হতে পারে, সংস্কৃতি কোন ধর্মীয় ভাবাবেগ ছাড়াও পার্থিব জীবনের স্বাভাবিক বিকাশধারার ভেতর দিয়ে গড়ে উঠতে পারে। আর আসলাম, একটি ঐশী জীবন বিধান হিসেবে, ভাব ও বস্তুর সমন্বয়ে, দেহ ও আত্মার সমবায়ে পূর্ণাঙ্গ কাঠামোর মধ্যে মানুষের পার্থিব ও পারমার্থিক চাহিদা পূরণের সর্বাধিক গ্যারান্টি দিতে সক্ষম এবং সে কারণে ইসলামী জীবনের শৈল্পিক রূপায়ণ বিশ্বের যে কোন ধর্ম ও সংস্কৃতির চেয়ে অনেক বেশি সমৃদ্ধ ও সমর্থন যোগ্য। ইসলামী জীবনের প্রত্যেকটি আচরণের রয়েছে একটি নৈয়ামিক শৃঙ্খলা, ভাল ও মন্দের সীমানা দ্বারা চিহ্নিত। অতএব একজন খোদাভীরু বিশ্বাসীর জন্য ইসলামের জীবন বিধান থেকেই সঠিক ধর্মবোধ ও সংস্কৃতিকে গ্রহণ করতে হবে।
বি. দ্র. লেখাটি থেকে বিন্দুমাত্র উপকৃত হলে অন্যদের সাথে শেয়ার, কমেন্ট করতে ভুলবেন না। আপনিও হতে পারেন দ্বীন প্রচারের অন্যতম একজন সহযোগী।
এরকম আরো লেখা পড়ুনঃ
সামাজিকতার গুরুত্ব ইসলামে
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ একটি কুফরী মতবাদ
আল্লাহ সুব. অস্তিত্বের একটি বুদ্ধিবৃত্তিক প্রমাণ