পড়ুনঃ প্রথম পর্ব
তাবীয কি রোগমুক্তির কারণ
হতে পারে?
মহান আল্লাহ বলেন,
﴿ وَإِن يَمۡسَسۡكَ ٱللَّهُ بِضُرّٖ فَلَا كَاشِفَ لَهُۥٓ إِلَّا هُوَۖ وَإِن يَمۡسَسۡكَ بِخَيۡرٖ فَهُوَ عَلَىٰ
كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٞ ١٧ ﴾ [الانعام: ١٧]
‘আর যদি আল্লাহ তোমার কোনো ক্ষতি সাধন করেন, তবে তিনি ব্যতীত তা অপসারণকারী আর কেউই নেই। পক্ষান্তরে তিনি যদি তোমার কোনো কল্যাণ করেন, তবে তিনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান’। (আল-আন‘আম, ১৭)।
তিনি অন্যত্র বলেন,
﴿ وَإِن يَمۡسَسۡكَ ٱللَّهُ بِضُرّٖ فَلَا كَاشِفَ لَهُۥٓ إِلَّا هُوَۖ وَإِن يُرِدۡكَ بِخَيۡرٖ فَلَا رَآدَّ لِفَضۡلِهِۦۚ يُصِيبُ بِهِۦ مَن يَشَآءُ مِنۡ عِبَادِهِۦۚ وَهُوَ ٱلۡغَفُورُ ٱلرَّحِيمُ ١٠٧ ﴾ [يونس: ١٠٧]
‘আর যদি আল্লাহ তোমার কোনো ক্ষতি সাধন করেন, তবে তিনি ব্যতীত তা অপসারণকারী আর কেউই নেই। পক্ষান্তরে তিনি যদি তোমার কোনো কল্যাণ করতে চান, তবে তার মেহেরবানীকে অপসারণকারী কেউই নেই। তিনি তার বান্দাদের মধ্য হতে যাকে চান, তাকে স্বীয় অনুগ্রহ দান
করেন। বস্তুত তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, অতিশয় দয়ালু’ (ইউনুস, ১০৭)।
উল্লেখিত আয়াতদ্বয়ের মত
পবিত্র কুরআনের আরো বহু আয়াত স্পষ্ট প্রমাণ করে যে, একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ অনিষ্ট দূর করতে পারে না। সেজন্য বান্দা কল্যাণ অর্জনে এবং অকল্যাণ দূরীকরণে সেই আল্লাহ্র নিকটেই আশ্রয় গ্রহণ করবে। কারণে বা কারণ ছাড়াই মহান আল্লাহ কল্যাণ সাধন ও অকল্যাণ দূরীকরণ উভয়ই করতে
পারেন।
আর যেসব কারণে আল্লাহ
বান্দার কল্যাণ বা অকল্যাণ করেন, সেগুলি দুই ধরনের:
(১) শরী‘আত অনুমোদিত কারণ: মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা যেগুলিকে ‘কারণ’ হিসাবে নির্ধারণ করেছেন, সেগুলি শরী‘আত অনুমোদিত কারণ বলে গণ্য হবে। যেমন: দু‘আ, শরী‘আতসম্মত ঝাড়-ফুঁক। এগুলি আল্লাহ্র ইচ্ছায় বান্দার কল্যাণ লাভের বা অকল্যাণ দূরীকরণের শরী‘আত সম্মত কারণ হিসাবে পরিগণিত। সুতরাং যারা এই কারণগুলিকে কারণ হিসাবে গ্রহণ করবে, মূলতঃ তারা আল্লাহ্র নিকটেই আশ্রয় প্রার্থনা করবে। কেননা খোদ আল্লাহই সেগুলিকে কারণ হিসাবে গ্রহণের
নির্দেশ দিয়েছেন এবং স্পষ্ট বলে দিয়েছেন যে, বান্দা শুধুমাত্র তার
উপরই নির্ভর করবে; কারণের উপরে নয়। এর অন্তর্নিহিত কারণ হচ্ছে, যে মহান সত্ত্বা সেগুলিকে
কারণ হিসাবে নির্ধারণ করেছেন, তিনি সেগুলির প্রভাব
অকেজো করে দিতে পারেন। অতএব, সর্বাবস্থায় কেবলমাত্র তাঁর উপরেই নির্ভর করতে হবে।
(২) স্বাভাবিক কারণ: যেমন: পানি পান পিপাসা নিবারণের
কারণ, পোষাক পরিধান শীত নিবারণের কারণ। অনুরূপভাবে বিভিন্ন
উপাদান দিয়ে তৈরী ওষুধও স্বাভাবিক কারণ হিসাবে গণ্য হবে। এ দুই প্রকার কারণের মধ্যকার সম্পর্ক হচ্ছে, শরী‘আত অনুমোদিত প্রত্যেকটি কারণই
স্বাভাবিক কারণ; কিন্তু প্রত্যেকটি স্বাভাবিক কারণই শরী‘আত অনুমোদিত কারণ নয়। স্বাভাবিক কারণসমূহের মধ্যে যেগুলি গ্রহণের প্রতি
শরী‘আত উৎসাহিত করেছে, সেগুলি গ্রহণের অর্থই হচ্ছে আল্লাহ্র শরণাপন্ন হওয়া। কেননা তিনিই এগুলির মধ্যে বিশেষ গুণ দান করেছেন। ইচ্ছা করলে তিনি আবার এগুলির গুণ ও বিশেষত্ব উঠিয়েও নিতে পারেন, ঠিক যেমনিভাবে তিনি আগুনের পুড়িয়ে ফেলা বৈশিষ্ট্যটিকে
ইবরাহীম আলাইহিস সালামের জন্য উঠিয়ে নিয়েছিলেন।
মোদ্দাকথা: বিভিন্ন কারণ
এবং মাধ্যমের ক্ষেত্রে আমাদেরকে অবশ্যই তিনটি বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে:
এক: ইসলামী শরী‘আত কারণ হিসাবে নির্ধারণ করেনি এমন কোনো কারণকে কারণ
হিসাবে গ্রহণ করা যাবে না।
দুই: ইসলামী শরী‘আতে অনুমোদিত কোনো কারণকে কারণ হিসাবে গ্রহণ করলেও
তার উপর নির্ভর করা যাবে না; বরং নির্ভর করতে হবে এসব
কারণের সৃষ্টিকর্তা একমাত্র মহান আল্লাহ্র উপর।
তিন: এসব কারণ যতই বড় এবং শক্তিশালী হোক
না কেন, এসবগুলির সাথে রয়েছে তাক্বদীরের নিবিড় সম্পর্ক; এসব কারণ তাক্বদীরের বাইরে নয়। সুতরাং আল্লাহ যেভাবে ইচ্ছা সেগুলিতে কর্তৃত্ব করে থাকেন।
তাবীয জড় পদার্থ, যার নিজস্ব কোনো প্রভাব নেই এবং রোগমুক্তির সাথে যার সামান্যতম কোনো সম্পর্কও
নেই। কেননা আল্লাহ তাবীযকে অকল্যাণ দূরীকরণের কারণ হিসাবে
যেমন নির্ধারণ করেন নি, তেমনি তা স্বাভাবিক কারণ হিসাবেও পরিগণিত নয়। সেজন্য তাবীযের উপর নির্ভর করার অর্থ হচ্ছে মুশরিকদের মত মৃত ব্যক্তি, মূর্তি ইত্যাদির উপর নির্ভর করা, যেগুলি শোনে না, দেখে না, কোনো লাভ-ক্ষতিও করতে পারে না। অতএব, তাবীয ব্যবহারকারীকে অবশ্যই শার‘ঈ উপায় গ্রহণ করতে হবে। আর শার‘ঈ উপায়ের মানদণ্ড হচ্ছে, তার সপক্ষে দলীল প্রমাণিত হতে হবে। অতএব, যেহেতু তাবীয রোগমুক্তির কারণ হওয়ার সপক্ষে কোনো দলীল প্রমাণিত হচ্ছে না, সেহেতু তা কখনই রোগমুক্তির কারণ হিসাবে গণ্য হবে না।
তাবীযের সপক্ষে পেশকৃত দু’টি বর্ণনা
১. আমর ইবনে শু‘আইব তাঁর পিতার সূত্রে তাঁর দাদা থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের কেউ যখন ঘুমের ভেতর ভয় পায়, তখন সে যেন বলে,
«أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللَّهِ التَّامَّاتِ مِنْ غَضَبِهِ وَعِقَابِهِ وَشَرِّ عِبَادِهِ وَمِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِينِ وَأَنْ يَحْضُرُونِ»
তাহলে ঐ
ভয়ের বিষয়টি কখনই তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না’। সেজন্য আব্দুল্লাহ ইবনে আমর তার
প্রাপ্ত বয়ষ্ক সন্তানদেরকে এই দু‘আটি শিখাতেন। আর অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক সন্তানদের গলায় দু‘আটি লিখে
ঝুলিয়ে দিতেন[1]।
বস্তুত হাদীসটি
দুর্বল। কারণ হাদীছটির সনদে মুহাম্মাদ
ইবনে ইসহাক রয়েছেন, যিনি ‘মুদাল্লিস’ (مدلس) এবং
তিনি হাদীছটিকে ‘আন্‘আনা’ (عنعنة) বা ‘আন্’ (عن)
শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে
বর্ণনা করেছেন। আর কোনো মুদাল্লিস বর্ণনাকারী ‘আন্’ শব্দের মাধ্যমে হাদীছ বর্ণনা করলে তা গ্রহণযোগ্য হয় না।
তিরমিযী বলেন, হাদীছটি ‘হাসান-গরীব’।
শাওকানী বলেন, হাদীছটির সনদে মুহাম্মাদ
ইবনে ইসহাক রয়েছেন, যাঁর সম্বন্ধে উলামায়ে কেরামের বক্তব্য প্রসিদ্ধ[2]।
আলবানী বলেন, হাদীছটি ‘হাসান’, তবে বর্ণনায় আসা ‘আব্দুল্লাহ ইবনে আমর তার প্রাপ্তবয়ষ্ক সন্তানদেরকে এই
দু‘আটি শিখাতেন, অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক সন্তানদের
গলায় দু‘আটি লিখে ঝুলিয়ে দিতেন’ হাদীছের এ বাক্য ছাড়া[3]। অতএব, হাদীছের উল্লেখিত বাক্য
গ্রহণযোগ্য নয়।
২. আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন, বালা-মুছীবত আসার আগে যা ঝুলানো হয়, তা হচ্ছে তাবীয। কিন্তু বালা-মুছীবত আসার পরে যা ঝুলানো হয়, তা তাবীয নয়।
উক্ত বর্ণনায় আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা-এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, কুরআন থেকে তৈরীকৃত তাবীয। তাঁর মতে, বালা-মুছীবত এসে যাওয়ার পরে কুরআনের আয়াত তাবীয হিসাবে ঝুলানো যাবে, বালা-মুছীবত আসার আগে নয়। উক্ত বর্ণনায় আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা-এর সর্ব প্রকার তাবীযের বৈধতা প্রদান উদ্দেশ্য নয়। কেননা কুরআন দিয়ে তৈরী তাবীয ছাড়া অন্যান্য
সর্বপ্রকার তাবীয যে সর্বাবস্থায় শির্ক তা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা-এর মত ব্যক্তিত্বের কাছে
গোপন থাকার কথা নয়।
শরী‘আত সম্মত ঝাড়-ফুঁক প্রসঙ্গ
শরী‘আত নির্দেশিত পদ্ধতিতে কুরআন এবং ছহীহ সুন্নাহ থেকে গৃহীত
দু‘আর মাধ্যমে আল্লাহ্র কাছে আক্রান্ত
ব্যক্তির আরোগ্য লাভের প্রত্যাশায় যে ঝাড়-ফুঁক করা হয়, তা-ই শরী‘আত সম্মত ঝাড়-ফুঁক। ইসলামী শরী‘আতে নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে এই
ঝাড়-ফুঁক বৈধ করা হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে যেমন ঝাড়-ফুঁক করেছেন, তেমনি তিনি ঝাড়-ফুঁক নিয়েছেন। ‘আউফ ইবনে মালেক আল-আশজা‘ঈ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, জাহেলী যুগে আমরা ঝাড়-ফুঁক করতাম। ইসলাম পরবর্তী যুগে
রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমরা জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহ্র
রাসূল! ঝাড়-ফুঁকের ব্যাপারে আপনার
মন্তব্য কি? তিনি বললেন, ‘তোমাদের ঝাড়-ফুঁকে পঠিত বিষয়গুলিকে আমার কাছে পেশ কর। ঝাড়-ফুঁকে যদি শির্কের সংমিশ্রণ না থাকে, তবে
তাতে কোনো দোষ নেই’[4]।
ঝাড়-ফুঁকের প্রকারভেদ: ঝাড়-ফুঁক
সাধারণতঃ চার রকমের হয়ে থাকে:
১. শির্কী ও কুফরী শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে ঝাড়-ফুঁক করা অথবা উপকার-অপকারকে ঝাড়-ফুঁকের দিকে সম্পর্কিত করা। এই প্রকারের ঝাড়-ফুঁক কুফর এবং শির্ক বলে গণ্য।
২. এমন কিছু শব্দের মাধ্যমে ঝাড়-ফুঁক করা, যার অর্থ বোধগম্য নয়। এই প্রকারের ঝাড়-ফুঁক শির্কের মাধ্যম এবং হারাম।
৩. আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নাম, যেমন: ফেরেশতা, নবী বা ইসলামে
সম্মানিত অন্য কারো নামের মাধ্যমে ঝাড়-ফুঁক করা। এই প্রকার ঝাড়-ফুঁকও বৈধ নয়। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো
নামে শপথ করার যে বিধান, এই
প্রকার ঝাড়-ফুঁকেরও সেই একই বিধান।
৪. আল্লাহ্র নাম
বা তাঁর কালাম অথবা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদর্শিত হাদীছের মাধ্যমে ঝাড়-ফুঁক করা। এই প্রকার ঝাড়-ফুঁক শরী‘আতসম্মত।
শরী‘আত সম্মত ঝাড়-ফুঁকের শর্ত: ঝাড়-ফুঁক শরী‘আত সম্মত হতে হলে তাতে বেশ কিছু শর্ত থাকা যরূরী। যেমন:
(১) ঝাড়-ফুঁক আরবী ভাষায় অথবা যে কোনো বোধগম্য ভাষায় হতে
হবে।
(২) ঝাড়-ফুঁকে যা পড়া হবে, তা শরী‘আতে অনুমোদিত হতে হবে।
(৩) ঝাড়-ফুঁকের যে নিজস্ব কোনো প্রভাব এবং ক্ষমতা নেই,
তা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে হবে।
শরী‘আতসম্মত ঝাড়-ফুঁকের পদ্ধতি: কুরআন-হাদীছের
বহু দলীল প্রমাণ করে যে, নিজের জন্য নিজের ঝাড়-ফুঁক সবচেয়ে বেশী উপকারী, যদিও মানুষ এর বিপরীতটা মনে
করে এবং ঝাড়-ফুঁক প্রদানকারীকে খুঁজে বেড়ায়। এক্ষেত্রে তারা এমনকি মূর্খ, ভেলকিবাজ বা জাদুকরের কাছে যেতেও
কুণ্ঠা বোধ করে না। শার‘ঈ ঝাড়-ফুঁক চোখ লাগা, জাদু এবং নানাবিধ মানসিক
ও শারীরিক অসুখ-বিসুখ দূরীকরণে ফলপ্রসূ। চিকিৎসা বিজ্ঞান পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অনুশীলনের উপর নির্ভরশীল। শরী‘আত সম্মত ঝাড়-ফুঁক যেহেতু অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি চিকিৎসা জগৎ, সেহেতু এখানেও পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অনুশীলনের গুরুত্ব
কম নয়। অতএব, ঝাড়-ফুঁকের ক্ষেত্রে কোনো পদ্ধতি যদি পরীক্ষা-নিরীক্ষার
মাধ্যমে উপকারী প্রমাণিত হয় এবং তাতে শরী‘আত পরিপন্থী কোনো কিছু না থাকে, তবে তা বৈধ। যাহোক, বিভিন্নভাবে ঝাড়-ফুঁক করা যেতে পারে। যেমন:
১. রোগীর গায়ে ফুঁ এবং হাত দিয়ে স্পর্শ
ছাড়াই আয়াত বা মাসনূন দু‘আ পড়া। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোনো রোগী দেখতে যেতেন বা তাঁর কাছে রোগী আনা হত, তখন তিনি বলতেন,
«أَذْهِبِ البَاسَ رَبَّ النَّاسِ، اشْفِ وَأَنْتَ الشَّافِي، لاَ شِفَاءَ إِلَّا شِفَاؤُكَ، شِفَاءً لاَ يُغَادِرُ سَقَمًا»[5]
২. রোগীর গায়ে হাত দিয়ে স্পর্শসহ আয়াত
বা মাসনূন দু‘আ পড়া। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি
ওয়াসাল্লাম কারো ঝাড়-ফুঁক করলে
তাকে ডান হাত দিয়ে স্পর্শ করে বলতেন,
«أَذْهِبِ البَاسَ رَبَّ النَّاسِ، اشْفِ وَأَنْتَ الشَّافِي، لاَ شِفَاءَ إِلَّا شِفَاؤُكَ، شِفَاءً لاَ يُغَادِرُ سَقَمًا»[6]
৩. স্পর্শ এবং ফুঁসহ আয়াত বা মাসনূন দু‘আ পড়া। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন, রাসূল
সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন অসুস্থতা অনুভব করতেন, তখন সূরা ইখলাছ, নাস, ফালাক্ব পড়ে নিজের গায়ে ফুঁ দিতেন এবং হাত দিয়ে
স্পর্শ করতেন[7]।
৪. পানিতে বা তেলে আয়াত বা মাসনূন দু‘আ পড়ে তা পান করা বা ব্যবহার করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি
ওয়াসাল্লাম ছাবেত ইবনে ক্বায়েস ইবনে শাম্মাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু–এর জন্য পানি পড়ে তা তার গায়ে দিয়ে
দেন[8]। আমাদের সালাফে ছালেহীন এই পদ্ধতি ব্যবহার করতেন।
ঝাড়-ফুঁকের সময় পবিত্র কুরআনের অনেক সূরা
ও আয়াত পড়া যায়, তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে,
সূরা ফাতেহা: ঝাড়-ফুঁকের মাধ্যমে চিকিৎসার ক্ষেত্রে
আল্লাহ্র ইচ্ছায় সূরা ফাতিহা অত্যন্ত ফলপ্রসূ। আবূ সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, একদল
ছাহাবায়ে কেরাম কোনো এক সফরে ছিলেন। একটি আরব গোত্রের গোত্র
প্রধান দংশিত হলে একজন ছাহাবী সূরা ফাতিহার মাধ্যমে তাকে ঝাড়-ফুঁক করেন এবং আল্লাহ্র ইচ্ছায় সে সুস্থ হয়ে উঠে। খবরটি রাসূল
সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম–এর কাছে পৌঁছলে তিনি তা সমর্থন করেন[9]।
আয়াতুল কুরসী: ঘুমের সময় এবং বাসা-বাড়ীতে আয়াতুল কুরসী
পাঠ করলে তা আল্লাহ্র ইচ্ছায় শয়তান ও অন্যদের থেকে রক্ষাকবচ
হয়। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, রাসূল
সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যখন তুমি তোমার
বিছানায় ঘুমাতে যাবে, তখন আয়াতুল কুরসী পড়বে; তাহলে সকাল পর্যন্ত আল্লাহ্র পক্ষ থেকে তোমার জন্য
একজন হেফাযতকারী রাখা হবে এবং শয়তান তোমার নিকটবর্তীও হতে পারবে না[10]।
অন্য
বর্ণনায় এসেছে, আবূ
আইয়ূব আনছারী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, বাসা-বাড়ীতে আয়াতুল কুরসী পড়বে, তাহলে শয়তান তোমার নিকটবর্তী হতে পারবে না[11]।
সকাল-সন্ধ্যায় আয়াতুল কুরসী পড়লে তা শয়তান
থেকে বাঁচার কারণ হয়। কেউ তা সন্ধ্যায় পড়লে
সকাল পর্যন্ত এবং সকালে পড়লে সন্ধ্যা পর্যন্ত তার হেফাযত করা হয়[12]।
সূরা ফালাক্ব ও সূরা নাস: এ সূরাদ্বয় আল্লাহ্র ইচ্ছায় জিন এবং চোখ
লাগা বা বদনযর থেকে হেফাযতকারী। আবূ সাঈদ খুদরী
রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি
ওয়াসাল্লাম জিন ও বদনযর থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। যখন এই সূরা দু’টি নাযিল হল, তখন তিনি অন্য সবকিছু ছেড়ে এ দু’টি গ্রহণ করলেন[13]।
এ সূরা দু’টি বিভিন্ন বিপদাপদ, বালা-মুছীবত থেকে আল্লাহ্র নিকট আশ্রয় প্রার্থনার সর্বোত্তম হাতিয়ার[14]।
সূরা এখলাছ, ফালাক্ব ও নাস: এ সূরা তিনটি সকাল-সন্ধ্যায় তিনবার করে পাঠ করলে আল্লাহ্র ইচ্ছায়
এগুলি যে কোনো বিপদাপদ থেকে মুক্তির জন্য যথেষ্ট হবে[15]।
এ সূরা তিনটি বিভিন্ন
বিপদাপদ, বালা-মুছীবত থেকে আল্লাহ্র নিকট আশ্রয় প্রার্থনার
সর্বোত্তম হাতিয়ার[16]।
অসুখ-বিসুখ হলে এই সূরাগুলি দিয়ে রাসূল
সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঝাড়-ফুঁক করতেন[17]।
সূরা কাফেরূন: ঘুমের আগে এই সূরাটি পড়লে তা শির্ক থেকে মুক্তির কারণ হবে। ফারওয়া ইবনে নাওফাল তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তাঁর পিতা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম–এর কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহ্র
রাসূল! আমাকে এমন কিছু শিক্ষা দিন, যা
আমি ঘুমানোর সময় পড়তে পারি। তিনি বললেন, তুমি ﭑ ﭒ ﭓ শেষ পর্যন্ত পড়ে ঘুমাবে, তাহলে তা শির্ক থেকে মুক্তির কারণ
হবে[18]। হাদীছটিতে শির্কের মত মারাত্মক রোগ থেকে মুক্তির পথ
বাৎলে দেওয়া হয়েছে।
সূরা বাক্বারা: কোনো বাড়ীতে সূরা বাক্বারা পাঠ করলে
শয়তান সেই বাড়ী থেকে পালিয়ে যায়[19]। এই সূরায় যেমন রয়েছে বরকত, তেমনি তা জাদুকরদের শক্তি খর্ব করতে
পারে[20]।
সূরা বাক্বারার শেষ দুই
আয়াত: যে ব্যক্তি রাতে এই আয়াত
দু’টি পড়বে, তার জন্য এ দু’টি বালা-মুছীবত, শয়তান ইত্যাদি থেকে বাঁচার
ক্ষেত্রে যথেষ্ট হবে। আবূ মাসঊদ উক্ববা ইবনে
আমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে
ব্যক্তি রাতে সূরা বাক্বারার শেষ দুই আয়াত পড়বে, তার জন্য এ
দু’টি যথেষ্ট হবে[21]।
কোনো গৃহে এই আয়াত দু’টি তিন রাত পড়লে শয়তান ঐ গৃহের নিকটবর্তীও হতে পারবে
না[22]।
কোনো রোগীকে ঝাড়-ফুঁক করার সময় বলবে,
«بِسْمِ اللهِ أَرْقِيكَ، مِنْ كُلِّ شَيْءٍ يُؤْذِيكَ، مِنْ شَرِّ كُلِّ نَفْسٍ أَوْ عَيْنِ حَاسِدٍ، اللهُ يَشْفِيكَ بِسْمِ اللهِ أَرْقِيكَ»[23]
শরীরের কোথাও ব্যথা অনুভব
করলে ব্যথার স্থানে হাত রেখে ৩ বার بِسْمِ اللهِ বলবে এবং ৭ বার নিম্নোক্ত দু‘আটি পড়বে:
«أَعُوذُ بِاللهِ وَقُدْرَتِهِ مِنْ شَرِّ مَا أَجِدُ وَأُحَاذِرُ»
এছাড়া আরো অনেক আয়াত ও দু‘আ রয়েছে, যেগুলি দিয়ে ঝাড়-ফুঁক করা যায়। অনুরূপভাবে সকাল ও সন্ধ্যায় পঠিতব্য যিকর-আযকার ও দু‘আসমূহ আল্লাহ্র ইচ্ছায় আমাদেরকে শয়তানের কুমন্ত্রণা এবং নানা শারীরিক ও
মানসিক রোগ-ব্যাধি থেকে রক্ষা করতে পারে।
পরিশেষে, মহান আল্লাহ্র কাছে ফরিয়াদ জানাই,
তিনি আমাদেরকে যাবতীয় শির্ক, বিদ‘আত, বিভ্রান্তি ও
কুসংস্কার থেকে রক্ষা করে নির্ভেজাল তাওহীদের উপর আমাদের মৃত্যু দান করুন এবং
পরকালে জান্নাতুল
ফেরদাউস নছীব করুন। আমীন!
তাবিজ বিষয়ক একটি চমৎকার পিডিএফ বা ই-বুক ডাউনলোড করুন মাত্র একএমবির এখানে
[1] আবু দাঊদ, হা/৩৮৯৩; তিরমিযী, হা/৩৫২৮; আহমাদ, হা/৬৬৯৬।
[2] ফাতহুল ক্বাদীর, হা/৩৫৮৮।
[3] (ছহীহ তিরমিযী হা/৩৫২৮; সিলসিলা ছহীহাহ, ১/৫২৯)।
[4] (ছহীহ মুসলিম, হা/২২০০)।
[5] (বুখারী, হা/৫৬৭৫)।
[6] (বুখারী, হা/৫৭৫০)।
[7] (বুখারী, হা/৫৭৫১; মুসলিম, হা/২১৯২)।
[8] (আবূ দাঊদ, হা/৩৮৮৫)।
[9] (বুখারী, হা/৫৭৪৯; মুসলিম, হা/২২০১)।
[10] (বুখারী, হা/২৩১১, ৫০১০)।
[11] (তিরমিযী, আহমাদ, শায়খ আলবানী হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন, ছহীহ তিরমিযী, হা/ ২৮৮০ ও ছহীহ তারগীব ওয়া তারহীব, হা/ ১৪৬৯ দ্র:)।
[12] (ছহীহ তারগীব, হা/ ৬৬২, ১৪৭০; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৩২৪৫)।
[13] (আলবানী, ছহীহ তিরমিযী, হা/২০৫৮; ছহীহ ইবনে মাজাহ, হা/২৮৪৬)।
[14] (আলবানী, ছহীহ আবূ দাঊদ, হা/১৪৬৩)।
[15] (ছহীহ আবূ দাঊদ, হা/৫০৮২; ছহীহ তিরমিযী, হা/৩৫৭৫)।
[16] (নাসাঈ, হা/৭৮৪৫; হায়ছামী, মাজমা‘উয-যাওয়ায়েদ, ৭/১৫২, তিনি বলেন, হাদীছটি বাযযার বর্ণনা করেন এবং এর বর্ণনাকারীগণ ছহীহ বুখারীর বর্ণনাকারী)।
[17] (বুখারী, হা/৫০১৬; মুসলিম, হা/২১৯২)।
[18] (ছহীহ তিরমিযী, হা/৩৪০৩; ছহীহ আবূ দাঊদ, হা/৫০৫৫)।
[19] (মুসলিম, হা/৭৮০; তিরমিযী, হা/২৮৭৭)।
[20] (মুসলিম, হা/৮০৪)।
[21] (বুখারী, হা/৫০০৮; মুসলিম, হা/৮০৮)।
[22] (ছহীহ তিরমিযী, হা/২৮৮২; হাকেম, ২/২৬০)।
[23] (ছহীহ মুসলিম, হা/২১৮৬)।