হযরত ওমরের (রাঃ) খেলাফত কালে (৬৩৭ খৃ:) জেরুজালেম মুসলমানদের দখলে আসে। বিজয় যখন মুসলমানদের আয়ত্তে তখন জেরুজালেমের অধিপতি পেট্রিয়ার্ক সফ্রোনাস (Patriarch Sophronius) আবেদন করেন যে তাদের আত্মসমর্পণ স্বয়ং খলিফার উপস্থিতিতেই হতে হবে এবং খলিফাকেই তাদের দাবি দাওয়ার কথা শুনতে হবে। তার এই আবেদন মঞ্জুর করা হয়।
এরই ভিত্তিতে ওমর (রাঃ) জেরুজালেমে পৌঁছেন। তার পরের দিন ফজরের সময় হযরত বিলাল (রা) কে আজান দিতে আহবান করেন। নবী (সাঃ) ওফাতের পর থেকে বিলাল (রাঃ) আর আজান দিচ্ছিলেন না। কিন্তু এই মহান মূহুর্ত্তে খলিফার আবেদনে যখন দাড়িয়ে যান এবং আজান দেন তখন সাহাবীরা (রাঃ) কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছেন। এই স্বরের সাথে কত স্মৃতি, কত ইতিহাস, কত আবেগ।
সকাল বেলায় আবু ওবায়দা (রাঃ) কে তাঁর আগমন সংবাদ সফ্রোনাসকে দিতে বলেন। তাই করা হল। কিন্তু এক পর্যায়ে সফ্রোনাসের সাথে তিনি যখন কেবল আবু ওবায়দা (রাঃ) কে নিয়ে যেতে উদ্যত হয়েছেন তখন তাঁর সাথিরা বলেন, আমিরুল মু’মিনীন আপনি বিনা নিরাপত্তায় যাচ্ছেন, আমাদের ভয় হয় যে যদি তারা বিশ্বাসঘাতকতা করে বসে, অথচ আপনার সাথে নিরাপত্তার কিছু নেই। ওমর (রাঃ) পাঠ করলেন, قُل لَّن يُصِيبَنَآ إِلاَّ مَا
كَتَبَ ٱللَّهُ لَنَا هُوَ مَوْلاَنَا وَعَلَى ٱللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ
ٱلْمُؤْمِنُونَ -বলুন, আমাদেরকে কোন মুসীবত আক্রান্ত করতে পারবে না কেবল তা ব্যতীত যা আল্লাহ আমাদের জন্য লিখে রেখেছেন; তিনি আমাদের প্রভু, আমাদের নির্বাহক। সুতরাং বিশ্বাসীরা কেবল আল্লাহর উপরই নির্ভর করা উচিত, (৯:৫১)।
অতঃপর ওমর (রাঃ) পেট্রিয়ার্ক সফ্রোনিসাসের সাথে সাক্ষাত করেন এবং তাদের জানমাল ও ধর্মীয় নিরাপত্তা বিষয়াদি নিশ্চিত করেন। সেই হতে জেরুজালেমে সকল ধর্মের (ইয়াহুদী/খৃষ্টীয়ান) লোকজনের যাওয়া আসা, ইবাদত-আরাধনার নিরাপত্তা বিধিত হয় এবং এটা এভাবেই যুগপৎ হয়ে পড়ে।
প্রথম ক্রুসেড
এগারো শতাব্দীতে ইউরোপিয়ান শাসকেরা ধর্মীয় এবং বাণিজ্যিক অভিপ্রায়ে জেরুজালেমকে মুসলমানদের হাত থেকে কেড়ে নিতে পরিকল্পনা শুরু করেন। এই কাজ করতে গিয়ে তারা যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূচনা করেন -তা ছোট বড় আকারে ১৩ শো শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত চলতে থাকে। তাদের যুদ্ধ ও দখলদারিতে প্রাণহাণী ঘটান, নানান রকমের অত্যাচার ও নির্যাতন করেন এবং সর্বোপরি যুদ্ধের অর্থ সংগ্রহ করতে এবং সৈন্য সংগ্রহ করতে গিয়ে ইসলাম ও মুসলমানদের বিপক্ষে যে চরম মিথ্যাচার ও প্রোপাগান্ডা করেন তার জের এখনও শেষ হয় নি। ইউরোপ ও মুসলমানদের মধ্যে হাজার বৎসরের টানাপোড়নের সম্পর্ক এই যুদ্ধাংলেহী তৎপরতায় সৃষ্ট।
১০৬০ এর দশকে সেলজুক (মুসলিম) তুর্কীদের হাতে জেরুজালেমের কর্তৃত্ব চলে গেলে পশ্চিমা দেশে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, কেননা যেকোনো পটপরিবর্তনে অনিশ্চয়তা ও সন্দেহের অবকাশ দেখা দেয়। কিন্তু পরিবর্তন সাধারণ ছিল না, এটা ইউরোপিয়ানদের সামনে যুদ্ধের একটি অজুহাত খাড়া করে দেয়। ১০৯৫ সালে বুউয়েঁর গডফ্রি (Godfrey of Bouillon, একজন ফরাসী) সসৈন্যে জেরুজালেমের দিকে অগ্রসর হন। ১০৯৯ সালে মুসলমানদেরকে পরাজিত করেন এবং জেরুজালেম তাদের দখলে আনেন। এই যুদ্ধে গোটা ক্যাথোলিক চার্চ ও পোপ ২য় আর্বানের (১০৩৫-১০৯৯) সমর্থন ও আশীর্বাদ ছিল।
বিজয়ের পর ক্রুসেড যোদ্ধারা জেরুজালেমে রক্তের বন্যা বহান। এটা ইউরোপিয়ানদের নিজ বিবরণ অনুযায়ী। [১] শহরে কী নারী, কী পুরুষ, কী শিশু, কী বৃদ্ধ –যাকেই পাওয়া গেছে, তাকেই নিধন করা করা হয়েছে। বহমান রক্তে নাকী সেদিন ঘোড়ার খোর পিছলে যাচ্ছিল। এই ছিল নিধনের নৃশংসতা।
বিজয় ধরে রাখা, পরবর্তী যুদ্ধাদি চালিয়ে যাওয়া এবং সর্বোপরি প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে গডফ্রি জেরুজালেমের বাদশার পদে সমাসীন হন।
নাইট টেম্পলারদের আত্মপ্রকাশ
১১১৮ সালে (মতান্তরে ১১১৯ সালে) বাদশাহ ২য় বল্ডউইনের সময় সন্ন্যাসীদের মধ্য থেকে একদল স্থায়ী সেনাবাহিনী তৈরির প্রস্তাব আসে –যাদের কাজ হবে তীর্থযাত্রীদের প্রতিরক্ষা ও জেরুজালেম সংরক্ষণ। এই বাহিনী তৈরির মূলে ছিলেন হিউ ডি প্যান, ((একজন ফরাসী নৌবলম্যান (noble man,রাজকীয় প্রথায় একজন সম্মানিত, উচ্চ পদস্থ ব্যক্তি))। এই বাহিনীর মাধ্যমে ইউরোপ থেকে ব্যবসায়/ধর্মীয় যাত্রার নিরাপত্তা বিধানের এক ধরনের ফ্রাঞ্চাইজ নেয়া হয়। ঐতিহাসিকদের কেহ কেহ এই উদ্দেশ্যদ্বয়ের উপর দ্বিমত করেন। তাদের ধারণা যে এই বাহিনী তৈরির ‘মতলব’ অন্যস্থানে ছিল। ঘটনা যাই হোক এর নাম দেয়া হয় The Order of the Poor Knights of the Temple of King Solomon সংক্ষেপে the Knight Templars। এক দিকে ওরা সন্ন্যাসী আর অপর দিকে নিবেদিত যোদ্ধা, খোদার যোদ্ধা। যদিও নামের মধ্যে ‘দরিদ্র’ (poor) শব্দটি আছে কিন্তু শব্দে যা’ই থাকুক বাস্তবে এভাবে থাকবেনা। নামের তাৎপর্যের দিক দিয়ে ‘নাইট টেম্পলার’ হল ধর্ম যোদ্ধা, সন্ন্যাসী যোদ্ধা। এটা ভারতের শিবসেনার সমার্থক, এই যোদ্ধারা ও তাদের জীবন স্রেফ যুদ্ধ কেন্দ্রিক, সমর নিবেদিত।
সেদিন যে বাহিনীটি গড়া হয়েছিল তা অদূর ভবিষ্যতে এক বিরাট বাহিনী হয়ে উঠতে যাচ্ছিল। তারা আগামীতে ধনসম্পদের পাহাড় গড়বে, রাজকীয় প্রশাসনের মোকাবেলায় হুমকি হবে এবং অবশেষে তাদেরকে মেরে শিকড় নির্মূল করার চেষ্টা করা হবে। কিন্তু এই উদ্দেশ্য সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হবে না। মনে রাখতে হবে, এদের অস্তিত্ব ছিল চার্চের নামে, ধর্মের আওতায়, চার্চ ও রাজার যৌথ শাসনের অধীনস্থ হয়ে যা পরবর্তীতে ইউরোপের ধর্ম ও শাসন ব্যবস্থায় প্রবল ছাপ মারবে। শুধু যে তাই, তা নয়, পরবর্তীতে মানুষ ধর্ম, চার্চ, যুদ্ধ, নৃশংসতার ‘মিলনের সম্পর্কে’ বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠবে। তাছাড়া মধ্যযুগ, যুক্তির যুগ এবং এনলাইটনম্যান্টের যুগ পর্যন্ত ধর্ম ও শাসন ব্যবস্থায় ফাটল ধরাতে যেসব উপাদান কাজ করে থাকবে, এটাই হবে তাদের একটি।
বাদশাহ বল্ডউইন ক্রুসেড যোদ্ধাদেরকে জেরুজালেম মসজিদের কর্তৃত্ব দান করেছিলেন। এক সময় তারা মসজিদের মাটির নিচে একটি বিরাট ধনভাণ্ডার লাভ করে। তারা নাকি ভিত্তিস্থ মাটি খুড়ে ark of covenant পায়। মতান্তরে সেটি ছিল হলী গ্রেইল (Holy Grail)। তবে এর উপর আরও মতামত আছে। যেমন ডেড সী ক্রোল (dead-sea scroll), কোনো মৌলিক অতি বিরল তত্ত্ব, যীশুর কোন শিষ্যের কর্তিত মাথা অথবা ৭০ খৃষ্টাব্দে রোমানরা জেরুজালেম আক্রমণ করলে ইয়াহুদীগণ তাদের সোনা-রূপা স্থানে স্থানে গোপন করে যে ম্যাপ তৈরি করে রেখেছিল সেই ম্যাপ আবিষ্কার এবং সেই বিপুল সম্পদাদি উদ্ধার ইত্যাদি। [২] তবে মূল বস্তুটি কী ছিল –তা নিশ্চিত করা না গেলেও জিনিসটি যে অতি গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা তাদের এক ‘চূড়ান্ত-মুক্তি সনদ’ থেকে বুঝা যায়। টেম্পলারদের প্রধান ফ্রান্সে আসেন। চার্চ প্রধান, বাদশাহ ও অবশেষে পোপের সাথে দেখা করেন এবং তার কাছ থেকে একটি অনাক্রম্যতা (immunity) লাভ করেন এই অর্থে যে কোনো দেশের আইন তাদেরকে স্পর্শ করতে পারবে না, তাদেরকে কোনো রাষ্ট্রীয় নিয়মনীতি মানতে হবেনা, খাজনা ইত্যাদি দিতে হবেনা। [প্রাগুক্ত নোট ২)] এটা কেন? তারা সেখানে কী মহামূল্যের বস্তু পেয়েছিল –এসব সব প্রশ্নের কোন সঠিক উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি। তবে তখন থেকে তারা এক ওঠাল সম্পত্তির মালিক হয়, ইউরোপ জুড়ে তাদের ক্ষমতা বিস্তার হয়। তাদের হাতে একটি ব্যাংকিং সিস্টেমও গড়ে ওঠে। তীর্থযাত্রীরা নিরাপত্তার জন্য নিজেদের অর্থ (সোনা/রূপা) ওদের দফতরে জমা দিত এবং মোকাবেলায় সেই মূল্যের কাগজের রিসিট নিয়ে পাড়ি জমাত। নির্দিষ্ট শহরাদিতে রিসিট দেখিয়ে টাকা তুলতে পারত। এই সার্ভিসের জন্য ১০% চার্চ করা হত। তীর্থ ছাড়া সাধারণভাবে এই সিস্টেম ব্যবহৃত হয়।
দ্বিতীয় ক্রুসেড
ক্রুসেডের যুদ্ধ কয়েক দফা হয়েছিল। জেরুজালেম ক্রুসেডদের দখলে থাকা অবস্থায় তারা সেখান থেকে অপরাপর স্থান দখল করার জন্যও যুদ্ধ করে। তাছাড়া ইউরোপ থেকে এই উদ্দেশ্যে আরও যুদ্ধাদি নিয়ে যাওয়া হয়। এগুলোর সবই ক্রুসেডের যুদ্ধ, ধর্মের যুদ্ধ।
একজন ফরাসী এবোট বার্নার্ড অব ক্লেয়ারভক্স (Bernard of Clairvaux) এর আহবানে বাদশাহ ৭ম লুইস ও ৩য় কনরাডের অধীনের একটি ক্রুসেড ১১৪৭ থেকে ১১৪৯ পর্যন্ত চালানো হয়। কিন্তু তারা এই অভিযানে তেমন কোন ফায়দা হাসিল করতে পারেননি। [উইকি, ৩]
সালাউদ্দীন আইয়ূবীর জেরুজালেম উদ্ধার
সালাউদ্দীনের সাথে ক্রুসেডদের যুদ্ধ হয় ১১৮৭ সালে। এর কয়েক দশক আগে অপর এক ক্রুসেড যুদ্ধে এই মর্মে বিরতি (truce) আসে যে খৃষ্টীয়ানরা মুসলমানদেরকে হজ্জে যাতায়াতে বাধা দেবে না, ব্যবসায় কাফেলাদেরকে এবং ধর্মীয় কাজে বিঘ্নতা সৃষ্টি করবেনা। এটাই প্রায় চার যুগ ধরে চলছিল। কিন্তু ১১৮৭ সালের জানুয়ারি মাসে একটি হজ্জযাত্রী কাফেলাকে রেনোল্ড (Raynald) আক্রমণ করেন, মালামাল লুট করেন এবং তাদেরকে মারধর করে জেলে নিক্ষেপ করেন। রেনোল্ডের উদ্দেশ্য ছিল সালাউদ্দীনকে যুদ্ধে নামানো। অবস্থা এই ছিল যে জেরুজালেমের বাদশাহ বল্ডউইন কোষ্ঠরোগে দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। তাই তিনি তার ভায়রা (brother in-law) গী অব লুসিগনান (Guy of Lusingnan) রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দেন, (made him a regent)। কিন্তু গীর সে ধরনের তেমন কোন দক্ষতা ছিল না। তাই তার এক প্রাক্তন-মৈত্রী রেনোল্ড তার কাজে সহায়তা করতেন এবং ‘সুযোগও গ্রহণ করতেন’। [উইকি, ৪]। রেনোল্ড একজন রক্ত-লিপ্সু ব্যক্তি ছিলেন। [প্রাগুক্ত, নোট ১] । তবে রেনোল্ড কর্তৃক ব্যবসায় কাফেলাকে ইতিপূর্বে হয়রানী করার অভিযোগও আছে।
পার্শ্ববর্তী এলাকায় মুসলমানদের ঐক্য ও শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছিল তাই রেনোল্ড ইচ্ছে করেই সালাউদ্দীনকে যুদ্ধে নামিয়ে চূর্ণ করার পরিকল্পনা করেন। এই উদ্দেশেই একটি নিরপরাধ, নিরস্ত্র, হজ্জগামী কাফেলাকে আক্রমণ। এরই জওয়াব দিতে আসেন সালাউদ্দীন আইয়ূবী। ১১৮৭ সালে তিনি ক্রুসেডদেরকে দারুণভাবে পরাজিত করেন এবং জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করেন। তাঁর জেরুজালেমে প্রবেশ ও বিজয় ছিল রক্তহীন।
তৃতীয় ক্রুসেড
সালাউদ্দীনের বিজয় ইউরোপে তুমুল ক্ষোভ ও বিকম্পন সৃষ্টি করে। পোপ ৩য় আর্বান হার্ট এটাক করে মারা যান। স্মরণ রাখা দরকার যে ১০৯৯ সালে যখন জেরুজালেম ক্রুসেডরা দখল করে তখন পোপ ২য় আর্বানের মৃত্যু হয়। পোপ ৭ম গ্রিগোরি পালটা ক্রুসেড নিয়ে যাওয়ার জন্য আহবান করেন। জার্মানের ১ম ফ্রেড্রিক বারোসা, ফ্রান্সের ২য় ফিলিপস অগাস্টাস এক বিরাট বাহিনী নিয়ে জেরুজালেমের দিকে যাত্রা করেন। পথে কোনো এক নদীতে ফ্রেড্রিক ডুবে মরেন। কুলক্ষণ ভেবে বা নিরাশ হয়ে তারা যাত্রা ভঙ্গ করেন।
১১৮৯ সালে ইংল্যান্ডের বাদশাহ তৃতীয় রিচার্ড সেকালের সবচেয়ে ভারী অস্ত্র ও কামান সহ ১৭,০০০ সৈন্য নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। (প্রাগুক্ত, নোট ১) গন্তব্যস্থলে পৌঁছিলে তার সাথে সিভিলিয়ান হয়ে থাকা ও পলাতক ক্রুসেডরা শরিক হন। তাছাড়া সেই অঞ্চলের খৃষ্টিয়ান সৈন্যরা যারা আগে বল্ডউন ও গীর অধীনে ছিল –তারাও সংঘবদ্ধ হন। অপরদিকে সালাউদ্দীনের সৈন্য সংখ্যা দিন দিন কমে আসছিল, কেননা তার লোকজন ছিল জেহাদ করতে আসা নানান অঞ্চলের কৃষিজীবী মানুষ –যারা পরিবার পরিজন ও ক্ষেত-খামার রেখে বৎসরের পর বৎসর লেগে থাকার মত অবস্থানে ছিল না।
রিচার্ড বিপুল শক্তিতে যুদ্ধ শুরু করেন। তিনি একর, জাফা, কেসারিয়া এবং টায়ার –এই শহরগুলো মুসলমানদেরকে পরাজিত করে নিজ দখলে নেন। দু এক শহরে তুমুল যুদ্ধে কখন এই পক্ষ কখন সেই পক্ষ বিজয় লাভ করতে থাকে।
কিন্তু রিচার্ড প্রথমে একর দখল করেই সেখানে যুদ্ধাপরাধ করেন। তার হাতে ২,৭০০ মুসলিম সৈন্য ধরা পড়লে তিনি কয়েক হাজার স্বর্ণমুদ্রার বিনিয়ে মুক্তিপণে ফিরৎ দিতে রাজি হন। কিন্তু স্বর্ণ হস্তান্তর ও সৈন্য ফিরৎ পাওয়া প্রক্রিয়া স্পষ্ট করতে খানিক দেরি হলে তিনি সকল সৈন্যদেরে সারিবদ্ধ করে শিরচ্ছেন করেন। [প্রাগুক্ত, নোট ১]
অনেক তুমুল যুদ্ধের পর ১১৯২ সালে উল্লেখিত শহরগুলো তার কর্তৃত্বে রেখে এবং জেরুজালেম আক্রমণ না করেই রিচার্ড ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন। রিচার্ড তখন আহত ছিলেন। ঐতিহাসিকদের মতে তিনি জেরুজালেম বিজয় করতে পারবেন বলে মনে করেননি অথবা বিজয় করলেও তা ধরে রাখতে পারবেন বলে নিশ্চিত ছিলেন না। পরবর্তী বৎসর সালাদ্দিনের মৃত্যু হয়। (ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। ক্রুসেডদের অনুশোচনা ছিল যে রিচার্ড যদি কোনো রকমে আরও একটি বৎসর থেকে যেতে পারতেন তবে সালাউদ্দীনের মৃত্যুতে তার উত্তরাধিকার নিয়ে যে অন্তর্দ্বন্দ্ব শুরু হয় তার সুযোগে জেরুজালেম আক্রমণ করা যেত এবং হয়ত বিজয় আসত। ইংল্যান্ড ফেরার কয়েক বৎসর পর অর্থাৎ ১১৯৯ সালে রিচার্ড মারা যান) ।
অন্যান্য ক্রুসেড
রিচার্ডের ইচ্ছে ছিল তিনি আরেক দফা অভিযান চালাবেন। কিন্তু জেরুজালেমে আহত হবার পর সে ক্ষতস্থান আর পুরোপুরি ভাল নি বরং সেই ক্ষত থেকেই তার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুতে ক্রুসেড যুদ্ধ থেমে যায়নি। এই যুদ্ধ তার পরের একশো বছর পর্যন্ত চলতে থাকে। কিন্তু ক্রুসেডরা জেরুজালেম দখল করতে সমর্থ হননি। ছোট বড় যুদ্ধ হয়, তাদের মধ্যে হচ্ছে ১২০২-৪ সালে, ১২১২-২১ সালে, ১২২৮-২৯ সালে, ১২৪৯-৫৪ সালে, ১২৭০-৭২ সালে, ও ১২৯১ সালে। [৫]
নাইট টেম্পলারদের শেষ দশা
১২৯২ সালে একমাত্র শহর একর ব্যতীত আর কোনো শহর নাইট টেমপ্লারদের অধিকারে থাকেনি এবং ১২৯২ সালের যুদ্ধেই (মতান্তরে ১২৯১ সালে) তারা পরাজিত হয়ে তাদের শেষ লর্ড (Grand Master of the Knights Templar) জ্যাক ডি মলোয়সহ সাগর পাড়ি দিয়ে সাইপ্রাসে আশ্রয় নেন এবং সেখান থেকে ফ্রান্সের বাদশাহর কাছে মিলিটারি সাহায্যের আহবান পাঠান। কিন্তু বিধি বাম। কোনো সাহায্য আসেনি। ফ্রান্সের বাদশাহ ফিলিপ দ্যা ফেয়ার (Phillip the Fair) তখন নাইট-টেম্পলারদের কাছ থেকে নেয়া ধারের (debts) ভারে ডুবু ডুবু অবস্থায়। তাছাড়া দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা কাটিয়ে ওঠাও তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। তাছাড়া ইংল্যান্ডের সাথে তখন তার যুদ্ধের সম্পর্ক ছিল। লক্ষণীয় যে টেম্পলাররা তাদের টাকা সুদে ধার দিয়ে বাদশাহি চালাচ্ছিল, কিন্তু যুদ্ধের খরচের জন্য নিজেদের টাকা ব্যয় না করে বাদশাহকেই সে খরচ বহন করতে আবেদন করছিল যাতে বাদশাহ পরিশেষে সেই টাকা ট্যাক্সের মাধ্যমে জনগণের কাছ থেকে তুলে নেন। এই কারসাজি আর আজকের কারসাজির মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই। বড় বড় কর্পোরেশনের চাপে ইউরোপিয়ান সরকারগুলো যুদ্ধে যায় এবং ট্যাক্স পেয়ারের টাকায় সে যুদ্ধ চালায়। তারপর কর্পোরেশনগুলো যুদ্ধোত্তর ফায়দা হাসিল করে।
ডি মলোয় নিরাশ হয়ে ১৩০৭ সালে ফ্রান্সে আসেন কিন্তু ইত্যবসরে অনেক ষড়যন্ত্র হয়ে যায়। পোপের সম্মতি নিয়ে ফিলিপ জ্যাক ডি মলোয় ও তার অনুচরদেরকে গ্রেফতার করেন ও ১৩১৪ সালের মার্চ মাসে মৃত্যুদণ্ড দেন এবং তাদের হত্যার মাধ্যমে ফিলিপ কর্জমুক্ত হন। এসব কাজ পশ্চিমা দেশ এখনো আরব দেশের ডেসপট লীদারদের সাথে করে, তাদেরকে নির্মূল করে তাদের গচ্ছিত টাকা আত্মসাৎ করে। ডি মলোয় ও তার অনুচররা ১৩ই মার্চ শুক্রবার দণ্ডপ্রাপ্ত হন এবং এর পর থেকে Friday the 13th ইউরোপিয়ানদের কাছে একটি কুলক্ষণ হয়ে পড়ে!
টেমপ্লারদের উপর অভিযোগ আনা হয় যে তারা নাকী ধর্মচ্যুত বা বিপথগামী হয়েছিল, (heresy, ধর্ম বিশ্বাস থেকে সরে গিয়েছিল); তারা প্রচলিত ধর্মীয় বাহ্যিক আনুষঙ্গিকতার প্রয়োজনীয়তা মনে করত না; এমন কি মুসলিম জগতের সংস্পর্শে সূফী দার্শনিক কিছু সংযোজন ঘটানোর অভিযোগও ছিল। নির্যাতন কক্ষে মারপিট খেয়ে সবাই যত অভিযোগ ঢালা হয় তার সবই স্বীকার করেছিল। তারা শয়তানের (Lucifer) উপাসনার কথাও স্বীকার করে। তবে এমন স্বীকারোক্তিতে মূলত কিছুই প্রমাণিত হয় বলে মনে হয় না। অবশেষে জ্যাক ডি মলোয় ও তার সহপার্টি ৬০ জন নাইট-টেম্পলারকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।
কিন্তু বাকী টেম্পলাদের কী হল? তাদের বিরাট সম্পত্তির কী হল? তারা কোথায় গিয়ে আত্মগোপন করলো? এসবের কোন হদিস সেদিন পাওয়া যায় নি, বা সর্বসাধারণ জানে নি। অনেকের ধারণা যে এই নাইট-টেম্পলাররাই বিভিন্ন গোপন সোসাইটির আড়ালে থেকে কাজ করে যেতে থাকে, যেমন ফ্রিম্যাসন, ইলুমিনাটি ইত্যাদি।
শেষ কথা
ক্রুসেডের যুদ্ধগুলি মুসলিম ভূখণ্ডে অনেক বিপর্যয় এনেছে, অনেক প্রাণনাশ করেছে, তাদের জাতীয় জীবনে ও মানসিকতায় অনেক প্রভাব ফেলেছে। এই কথাটি আবার ইউরোপের ব্যাপারেও সত্য। দুই শো বৎসর ব্যাপী চালিত এই যুদ্ধ ইউরোপের রাজনীতি, সমাজ ও মনন জুড়ে রেখেছিল। যুদ্ধের জন্য বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাধারণ জনগণ স্বহস্তে ধন-সম্পদ দান করেছিল, যুদ্ধে গিয়ে জীবন দিয়েছিল, জীবন নিয়েছিল –এই যুদ্ধ তাই মামুলী ছিল না, হতেই পারত না।
সর্বোপরি মনে রাখতে হবে যে সকল বিপর্যয় ও নিষ্ঠুর দিকগুলোর পরও এগুলো ছিল ‘মানুষের’ কাহিনী, মানুষের ইতিহাস। এই যুদ্ধে মূল্যবোধের বিষয় ছিল, আদর্শগত বিষয় ছিল। এই যুদ্ধ তার সময় সীমায় যে মানসিকতা তৈরি করেছিল তার প্রতিক্রিয়া সুদূর প্রসারী হয়ে পড়েছিল –সেই মানসিকতার ছুঁয়াচ আজও অনুভব করা যায়। সেদিন সেই যোদ্ধারা বিজয়ী হওয়া, সামাজিক প্রশংসা ও স্বীকৃতি লাভ করা, গোনাহের স্বীকারোক্তির ঊর্ধ্বে ওঠা –এগুলো ছিল বিরাট বৈক্তিক, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদার ব্যাপার। (এই বিষয়াদির ব্যাপারে নিচের সূত্রায়িত একটি বই আছে,দেখা যেতে পারে, রেফ: ৫)
কিন্তু সবকিছুর পরও একথা স্পষ্ট যে মুসলমানদের হাতে জেরুজালেমে যে শান্তি-নিরাপত্তা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা বিরাজ করেছিল তা ইউরোপীয় খৃষ্টীয়ান পক্ষের হাতে হয়নি। সাধারণভাবে, মুসলমানদের শাসন ব্যবস্থায় চার্চ ও সামন্ততান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার মত জনগণ নির্যাতিত হয়নি। যেসব কারণের প্রেক্ষিতে ইউরোপ নাস্তিক্য ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ গ্রহণ করেছিল, সেই ধরণের কারণাদি ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় তুলনীয় ছিল না, যে কারণে সাম্রাজ্যবাদের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে, হাজার প্রোপাগান্ডা, শক্তি প্রয়োগ ও বলিষ্ঠ মিথ্যাচারের পরও ইসলাম যেভাবে দাড়িয়ে থাকে (এবং এখনো আছে) সেভাবে চার্চ ও সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা দাড়িয়ে থাকতে পারেনি।
আজ ইউরোপ একটু নমনীয় হয়ে প্যালেস্টাইন-সমস্যার সমাধান করলে বিশ্বের অনেক অশান্তির সমাধান হত। বিশ্ব অন্য ধরনের শান্তির পথ খোজ পেত। কিন্তু পশ্চিমের মন-মানসিকতার যে অংশে শক্তি নিহিত সে অংশ ইসলাম ও মুসলমানদের পদদলিত করা ছাড়া আর কোন ধারণা রাখে বলে মনে হয় না।
তবুও একবিংশ শতাব্দীর কামনা এই যে বিশ্বে শান্তি আসুক, মানুষ শান্তির পথ পাক, পশ্চিমের যেদেশগুলোর যেগুলো ওয়ার-ইকোনমি (war-economy) করে রেখেছে, সেগুলো সেই ধারা থেকে বেরিয়ে অন্য ধারা খুঁজুক। তবেই আশা করা যায় শান্তি ফিরবে।
এবারে একটি ভিডিও দেখা যেতে পারেঃ
লিখেছেন: এম_আহমদ
বি. দ্র. আমাদের সাইটটি ভাল লাগলে সাবক্রাইব করুন ও শেয়ার করুন।