সূচনা
আমাদের সমাজে কিছু কিছু লোক নিজেদেরকে ‘মুক্তমনা’ ভাবেন। তাদের দাবি হচ্ছে তারা নাকি মুক্ত-চিন্তক, যুক্তিবাদী। তারা ট্র্যাডিশন বা প্রাচীন প্রাতিষ্ঠানিকতা-মুক্ত অথবা এগুলো থেকে মুক্ত হতে কাজ করছেন এবং মানুষকে মুক্ত করতেও চাচ্ছেন।
অন্ধ বিশ্বাস
আবার যারা নিজেদেরকে ‘যুক্তিবাদি’ মুক্তমনা ভাবতে যাবে, তারা নাকি “বিজ্ঞানমনষ্ক” হয়ে “সংশয়ী” দৃষ্টিকোণ দিয়ে মিথ ও অতিকথাকে বিশ্লেষণ করতে হবে। কিন্তু বিশ্লেষণের পরে কেউ খোদায় বিশ্বাসে উপনীত হতে পারবে না, কেননা সেই সিদ্ধান্তের বিপরীতে গেলেই সর্বনাশ – আপনি মুক্তমনা থাকতে পারবেন না! বলতে হয়, হায়রে ঢেঁকি! তুমিও কি ‘অনার্য’?
**লেখাটির দ্বিতীয় অংশ পড়ুন এখানে
সাইটটি/লেখাটি ভাল লাগলে অন্যদের মাঝে শেয়ার করুন।
_____________________
[১] মুক্তমনা এডমিন, (২০০৮) মুক্তমনা কী? মুক্তমনা [অনলাইন] http://mukto-mona.com/bangla_blog/?page_id=519[Accessed 10 Oct 2012]
আমাদের সমাজে কিছু কিছু লোক নিজেদেরকে ‘মুক্তমনা’ ভাবেন। তাদের দাবি হচ্ছে তারা নাকি মুক্ত-চিন্তক, যুক্তিবাদী। তারা ট্র্যাডিশন বা প্রাচীন প্রাতিষ্ঠানিকতা-মুক্ত অথবা এগুলো থেকে মুক্ত হতে কাজ করছেন এবং মানুষকে মুক্ত করতেও চাচ্ছেন।
এখানে ‘মুক্তমনা’ হওয়ার যে দাবি বা বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হচ্ছে আমরা প্রথমে সেটা বুঝার চেষ্টা করব। প্রথমে ‘মুক্ত’ শব্দটি বিবেচনা করি। সরল-
সহজভাবে বলতে গেলে আমাদের ভাষার সকল শব্দ তাদের বিপরীত ধারণার মোকাবেলায় অর্থ লাভ করে। ঠাণ্ডা গরমের মোকাবেলায়, শক্ত নরমের মোকাবেলায়, সত্য মিথ্যার মোকাবেলায় ইত্যাদি। আমরা যখন বলি ‘মুক্ত আকাশের পাখি’, তখন ‘মুক্ত’ কোন্ জিনিস তা সহজে বুঝতে
পারি। আমরা যখন বলি পাখিটি খাঁচায় বন্দী, অথবা লোকটি এখন রাজার বন্দীশালায় আবদ্ধ, তখন আবদ্ধ, বন্ধন আর মুক্ত অবস্থার কথা বুঝি। উদাহরণের পাখিটি ‘নিজ ইচ্ছায়’ খাঁচায় গিয়ে আবদ্ধ হয়নি আর বন্দীশালার লোকটিও ‘নিজ ইচ্ছায়’ বন্দীদশা গ্রহণ করেনি। এখানে সতত ইচ্ছার স্বাধীনতা ও অধীনতা প্রকাশ পায়। আমরা যদি বন্দীশালার লোকটির ব্যাপারে বলি, সে এখন ‘মুক্ত’, তখন বুঝি যে এখন তার স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছে। সে এখন যথেচ্ছ বিচরণ করতে পারে। তার কর্মে ইচ্ছার স্বাধীনতা এসেছে। সে যেখানে সেখানে যেতে পারে। অর্থাৎ এখন সে স্বাধীন, সর্বাবস্থায় মুক্ত।
কিন্তু যে ব্যক্তি কোন বন্দীশালায় আবদ্ধ ছিল না, এবং এখনও নয়, সে যদি বলে যে ‘আমি এখন মুক্ত’ তাহলে বুঝতে হবে শব্দের রূপকতা (metaphoricity) ব্যবহার করা হচ্ছে। এই ধরণের রূপক ব্যবহার অনেক ভাবে করা যেতে পারে। এক ব্যক্তি বন্দীশালার ভিতরে থেকেও বলতে পারে, “আমি মুক্ত আকাশের পাখি।” এখানে শ্লেষাত্মক অথবা ব্যঙ্গাত্মক অর্থও আসতে পারে। এমন ব্যবহার সব ভাষাতে আছে। আমি গরীব লোক হয়েও বলতে পারি, “প্রাচুর্যের মধ্যে ডুবে আছি।” আপনি ‘বদ্ধমনা’ হয়েও বলতে পারেন মুক্তমনা, মুক্ত-চিন্তক। কেননা আপনি নিজের জন্য যখন কোনো শব্দ নির্বাচন করেন – তখন কোন্ শব্দটি নির্বাচন করবেন তা একান্ত আপনার ইখতিয়ারে। আপনার কানা ছেলেকেও নাম দিতে পারেন ‘পদ্মলোচন’। এতে কারো বলার কিছু নেই।সহজভাবে বলতে গেলে আমাদের ভাষার সকল শব্দ তাদের বিপরীত ধারণার মোকাবেলায় অর্থ লাভ করে। ঠাণ্ডা গরমের মোকাবেলায়, শক্ত নরমের মোকাবেলায়, সত্য মিথ্যার মোকাবেলায় ইত্যাদি। আমরা যখন বলি ‘মুক্ত আকাশের পাখি’, তখন ‘মুক্ত’ কোন্ জিনিস তা সহজে বুঝতে
পারি। আমরা যখন বলি পাখিটি খাঁচায় বন্দী, অথবা লোকটি এখন রাজার বন্দীশালায় আবদ্ধ, তখন আবদ্ধ, বন্ধন আর মুক্ত অবস্থার কথা বুঝি। উদাহরণের পাখিটি ‘নিজ ইচ্ছায়’ খাঁচায় গিয়ে আবদ্ধ হয়নি আর বন্দীশালার লোকটিও ‘নিজ ইচ্ছায়’ বন্দীদশা গ্রহণ করেনি। এখানে সতত ইচ্ছার স্বাধীনতা ও অধীনতা প্রকাশ পায়। আমরা যদি বন্দীশালার লোকটির ব্যাপারে বলি, সে এখন ‘মুক্ত’, তখন বুঝি যে এখন তার স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছে। সে এখন যথেচ্ছ বিচরণ করতে পারে। তার কর্মে ইচ্ছার স্বাধীনতা এসেছে। সে যেখানে সেখানে যেতে পারে। অর্থাৎ এখন সে স্বাধীন, সর্বাবস্থায় মুক্ত।
মনে রাখতে হবে যে কোনো শব্দের অর্থ তার শব্দের ‘ভিতরেই’ নিহিত নয়, বরং অর্থ হচ্ছে সামাজিক প্রথা-ভিত্তিক, সামাজিক convention এর অংশ, (আমরা সবাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত ভাষিক প্রথার ‘ভিতরেই’ থাকি, আমাদের অর্থ-বিনিময় [communication] এই প্রথার বাইরে নয়)।. আবার ‘অর্থ’ কোনো একটি শব্দ-কেন্দ্রিক নয়, বরং অর্থের-সংযুক্তিতে জড়িত অন্যান্য শব্দের জিঞ্জিরে (chaining with other words) গোটা ভাষা ব্যবস্থার (system of language) মধ্যে পরিব্যপ্ত।
‘মুক্তমনা’ যদি স্বাধীন চিন্তা ও স্বাধীন প্রত্যয় কেন্দ্রিক হয় এবং এরই প্রেক্ষিতে যদি এক ব্যক্তি বলে, “আমি খোদাতে বিশ্বাস করি না,” এবং অন্য ব্যক্তি যদি তার আপন স্বাধীন চিন্তা-চেতনা ও বিবেক অনুযায়ী বলে, “আমি খোদাতে বিশ্বাস করি”, তবে উভয়ই মুক্তমনা হওয়া উচিত। কিন্তু প্রথম ব্যক্তি যখন বলবে, “না, খোদাকে অস্বীকার না করলে মুক্তমনা হওয়া যাবে না”, তখন বুঝতে হবে সেই লোকটির কোন ‘মতলব’ আছে, সে কুযুক্তি উত্থাপন করছে। তারপর যখন সে জেদি হয়ে উঠবে এবং তার শেষ কথা হবে, আপনি ‘খোদাকে অস্বীকার করলেই’ মুক্তমনা হবেন, তখন বুঝতে হবে, এই ‘মুক্তমনা’ শব্দটি নিয়ে এখন ‘ধাপ্পাবাজি’ শুরু হয়েছে, ভাষার রাজনীতি শুরু হয়েছে। ধাপ্পাবাজ কোন নির্দিষ্ট কারণে নিজের জন্য ‘মুক্তমনা’ শব্দটি ব্যবহার করছে। সে তার আপন দাবীর বিপক্ষে স্ববিরোধী (inconsistent) হয়ে ভাব ও শব্দের এমন ব্যবহার করছে, কেননা it cannot be empirically proven that there is no God অর্থাৎ কোন বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে খোদা-নাই বলে প্রমাণ করা যাবে না।
তারপর মুক্তমনা হতে হলে পূর্ববর্তী সমাজ সভ্যতা, আচরণ, বিশ্বাস সব কিছুতেই ‘সন্দেহবাদী’ হতে হবে, প্রথাগত বিষয় (tradition) সমঝে না এলে বর্জনের জন্য আহবান জানাতে হবে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত বর্জিত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত আক্রমণাত্মক হতেই হবে। এই বৈশিষ্ট্য অর্জিত না হলে ‘মুক্তমনা’ হওয়া যাবেনা -এমন যুক্তিবাদী বরং ‘বক্রমনা’ই হতে পারে।. বক্রমনা যদি ‘সন্দেহবাদী’ হতে হয়, তবে তার নিজ ঘর থেকেই শুরু করতে পারে। সে তার নিজ মা-বাপের সন্তান কিনা এটাও সন্দেহে আনতে হবে, ব্যক্তির identity-এর মূল স্থান এখানে। তাকে প্রথমে DNA টেস্ট দিয়ে শুরু করতে হবে। তারপর তার পরিবারের সবার, তার মা-বাপ সহ। পরিবারের সয়-সম্পত্তি দেখতে হবে। তার পিতা-প্রপিতা ঘুষ ও চুরির মাধ্যমে সেটা করলো কিনা তা দেখতে হবে। সম্ভাব্য অসত্যের কাছে আত্মসমর্পণ করলে সে তার নিজের সাথেই প্রতারণা করবে, তাই এগুলো তার জানা চাই। ভাল কাজ ঘর থেকে শুরু হওয়া উচিত। এগুলো সন্দেহবাদী ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিসহকারে অনুসন্ধান চালানো দরকার। ধর্ম তো অনেক পরে আসবে।
অতঃপর ‘নিজ-জ্ঞানের’ প্রেক্ষিতের উপর সন্দেহবাদী হতে হবে। সে যা জানে তা কীভাবে জানে – এই ’নিশ্চয়তায়’ উপনীত হতে হবে। এটা হচ্ছে দর্শনের মূল স্থান। নিজের ‘জ্ঞানের’ স্থান স্পষ্ট হওয়ার আগেই অপরকে সন্দেহবাদী বানানোর ধৃষ্টতা না দেখালেই ভাল।
মূল কথা হচ্ছে এক ব্যক্তি যদি কোন ব্যাপারে ‘সন্দেহ’ পোষণ করে, তবে অপর ব্যক্তি সেখানে ‘সন্দেহ’ নাও করতে পারে, উভয়ের পক্ষে/বিপক্ষে যুক্তির এবং অযুক্তির স্থান থাকতে পারে। কেননা উভয়ের দেখার প্রেক্ষাপট, দেখার থিওরি, ভিন্ন হতে পারে। ভাষা-বিজ্ঞান, দর্শন, সমাজ বিজ্ঞান ইত্যাদিতে এভাবে ভিন্নতায় দেখার প্রেক্ষিত উপস্থাপন করে। আপনার কাছে যা সন্দেহজনক, আমার কাছে সেই সন্দেহ নাও থাকতে পারে, কেননা আমি বিষয়টি অন্যভাবে দেখে নিয়ে থাকতে পারি, আপনার মতো নয়। কিন্তু আপনার সন্দেহবাদকেই আপনি যখন আমার উপর চাপিয়ে দেবেন এবং আমি তা না মানতে পারলে আপনি আক্রমণাত্মক হয়ে উঠবেন, এমনটি হচ্ছে অসভ্য লোকের কাজ, ইতর প্রকৃতির কাজ, হিটলারের কাজ। হিটলারের দলও নিজেদেরকে মুক্তমনা ভাবতো, হিটলার নাস্তিক ছিল, যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানবাদের ভিত্তিতে উন্নত সমাজ-সভ্যতার কথা বিবেচনা করত।
অন্ধ বিশ্বাস
মুক্তমনাদের খেলা হচ্ছে ভাষিক ডিগবাজি, প্রতিপক্ষকে নেতিবাচক ব্যাখ্যায় আনা। ধাপ্পাবাজ নিজের জন্য ‘মুক্তমনা’ শব্দ নির্বাচন করে যখন বলে উঠবে, “আমার আস্থা মুক্তবুদ্ধিতে – অন্ধবিশ্বাসে নয়”, তখন রাজনৈতিক ধাপ্পাবাজদের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। রাজনৈতিক অঙ্গনে ধাপ্পাবাজি অনেকটা বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, বক্তব্যের উদ্দেশ্য স্পষ্টভাবে দেখা যায়।
এখানে এই ক্ষুদ্র phrase, ‘অন্ধ বিশ্বাস’-এর ভাষিক ব্যবহার কীভাবে সমঝের স্থানকে (place of perception) এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে – তার প্রতি লক্ষ্য রাখুন। এখানে ‘অন্ধ’ শব্দটি বিশেষণের বাইরে গিয়ে metaphor হয়ে কাজ করছে এবং এই ব্যবহারের মাধ্যমে ধারণার মূলবস্তুকে লক্ষ্যচ্যুত করা হচ্ছে, যুক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। অন্ধ রূপকতা (metaphor of blindness) উত্থাপনে চিন্তার লক্ষ্য রূপক বস্তুর দিকে নিবিষ্ট হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট হচ্ছে এবং এই রূপকতার সাথে জড়িত অর্থ-চিত্র (picturesque meaning) ধারণায় উপস্থিত হচ্ছে। কেউ যখন বলে ‘লোকটা কুত্তামনা’ তখন প্রবক্তা অপর ব্যক্তির মানবতাকে চূর্ণ করে তার বক্তব্যের স্থান তৈরি করে। কাউকে প্রথমেই অন্ধ-বিশ্বাসী আখ্যায়িত করে তার মানবীয় চিন্তাশক্তিকে বিকলাঙ্গ হিসেবে দেখিয়ে, তার প্রতি আক্রমণাত্মক হয়ে, নিজের বক্তব্যের স্থান তৈরি করা হয়। মুক্তমনার ধাপ্পাবাজ প্রবক্তারা এভাবেই ভাষার ব্যবহারে তাদের নাস্তিক-ধর্মের প্রচারণা চালাবার প্রয়াস পায়। এটা মূলত শাব্দিক অর্থের মুক্তমনা-বৈশিষ্ট্য বহন করে না, ধাপ্পাবাজ মানসিকতা বহন করে।
যে লোকটি প্রথমে নিজের জন্য ‘মুক্তমনা’ শব্দটি নির্বাচন করল, তারপর যখন খোদাতে বিশ্বাসীদের মোকাবেলায় তার অবস্থানকে ‘চাক্ষুষ’ এবং ওদের অবস্থানকে ‘অন্ধ’ শব্দে আখ্যায়িত করল, তখন তার ভাষিক আচরণ ও ব্যাখ্যার প্রকৃতিও অনেকটা স্পষ্ট। সে তার এই বৈশিষ্ট্য সর্বত্র প্রকাশ করবে, তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে এর রূপায়ন ঘটাবে। এমন লোক বিশ্বাসযোগ্য নয়। যাকে সে অন্ধ বলেছে, সে তার নিজ ‘বিশ্বাসের’ আলোকে তা করেছে, এটা তার নিজের দেখা ব্যাখ্যা, তার বক্তব্যের বাইরে বাস্তবতা ভিন্ন। সে অপরকে তার মতো define করছে, অপরকে হীন করছে। তার বিশ্বাসের প্রচারের জন্য ‘মুক্ত’ শব্দটি বেছে নিয়েছে, অপরকে অন্ধ আখ্যায়িত করছে। সে যা করছে, এটা তার ধর্মীয় কাজ। সে আরেক ধরণের ‘ধর্ম-ব্যবসায়ী’। সে মূলত পদ্মলোচন। শাব্দিক ব্যবহারের নব্য-ম্যাজিক দেখিয়ে তার ধাপ্পাবাজি প্রতিষ্ঠা করছে। ভাষার শব্দ সম্ভার থেকে যেগুলো পজিটিভ সেগুলো তার নিজের জন্য এবং যেগুলো নেগেটিভ সেগুলো প্রতিপক্ষের জন্য নির্ধারণ করছে। প্রতিপক্ষের বিশ্বাস “অন্ধ”, আর তার নিজের বিশ্বাস চাক্ষুষ (আলোকিত)! লক্ষ্য রাখতে হবে, সে কীভাবে arbitrarily “অন্ধ” বিশেষণটি অপরের সাথে জুড়ে দিয়েছে। “খোদা নাই” –এটাও তো যুক্তিতে প্রমাণিত নয়, empirically-ও প্রমাণিত নয়, তাহলে নাস্তিক্যবাদও তো সাক্ষাৎ “অন্ধ” হতে পারে।
নতুন বোতলে আরেক ধর্ম
মুক্তমনারা তাদের নতুন ধর্মকে পুরাতন ধর্মের মোকাবেলায় ভাষার মারপ্যাঁচ ও রূপকথায় নতুন বোতলে ঢালে। মানুষকে এভাবে তাদের নব্য-ধর্মে ‘শিকার’ করতে চায়, অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে সরিয়ে, নিজেদেরকে সেই আসনে বসাতে চায়। মুক্তমনা হতে হলে নাকি বংশ পরম্পরায় যা আসে তাকে অস্বীকার করতেই হবে। কোথাও যদি কোন আপ্তবাক্য থাকে যেমন, আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই, তা অমনি উড়িয়ে দিতে হবে। কেননা এটা বংশ পরম্পরায় চলে এসেছে। কিন্তু কথা হল কোন আপ্তবাক্যিক ধারণা/বিশ্বাস বংশ-পরম্পরায় প্রচলিত হয়ে এসেছে বলেই কি সেটাকে অবলীলায় পরিত্যাগ করতে হবে? এক শ্রেণীর ধারণা ত্যাগ করে অন্য শ্রেণীর ধারণা গ্রহণ করাতে অথবা এক গ্রুপের বিশ্বাস ও আদর্শ বর্জন করে অন্য গ্রুপের বিশ্বাস ও আদর্শ ধারণ করাতে “মুক্ত-ধারণা” আসে কীভাবে? কোনো স্বাধীন ব্যক্তি খোদা আছেন বললেই যদি ‘মুক্তমনা’ বৈশিষ্ট্য হারাতে হয়, তবে এই মুক্ত-ধর্ম মুক্ত হয় কীভাবে? এটা তো নিরেট ধাপ্পাবাজি। এখানে ‘অস্বীকৃতির’ কলেমাই হচ্ছে বড় কলেমা, এই মুক্ত ধর্মে পুরাতন ধর্মের মতো আরও কলেমা রয়েছে।
মুক্তমনা কম্পিউটারের উপমা দিয়ে বলতে চায় বিশ্বাসীদের মাথায় নাকি ভাইরাস ঢুকেছে, কিন্তু এখানেও সে ‘শব্দ’ নির্বাচন করছে, সে ‘উপমা’ নির্বাচন করছে। ভাইরাস তো বরং তারই মাথায়, কেননা প্রচলিত হাজার হাজার বছরের সামাজিক প্রথার ‘কম্পিউটারে’ সে ভাইরাসের কাজ করছে।
যুক্তি বটে, মুক্তমনা বটে!
প্রচলিত ধর্ম বলতে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ এগুলোই জানি। মুক্তমনাদের সংজ্ঞাতে তারা কিছু পরিচিতি দেয়। তারা কারা? তাদের সংজ্ঞাতে, “নাস্তিক (atheist), অজ্ঞেয়বাদী (agnostic), সংশয়বাদী (skeptic), মানবতাবাদীদের (humanist) সাধারণভাবে ‘মুক্তমনা সদস্য’ হিসেবে গণ্য করা হয়।” [১]
এখানে যাদেরকে সাধারণভাবে (generally) ‘মুক্তমনা’ ধারণার সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে তারা (অজ্ঞেয়বাদী/সন্দেহবাদী ও নাস্তিক মহল) ‘সাধারণভাবে’ মুক্তমনার প্রত্যয় ও দাবীতে নেই। ফুকো (Foucault), লিয়োটার্ড, (Lyotard), হাইডেগার (Heidegger), রোরটি (Rorty), ডেরিডা (Derrida) এবং এমন আরও অনেক পোস্টমডার্ন দার্শনিক রয়েছেন যাদের কেউ অজ্ঞেয়বাদী, কেউ নাস্তিক কিন্তু ওরা এনলাইটনম্যান্টের (বিজ্ঞানবাদ ও যুক্তিবাদের মাধ্যমে মানব জাতির সব সমস্যার সমাধানের চিন্তা, বা তাদের যুক্তিতেই মুক্তি, বিশ্বাসীরা যুক্তিহীন, ভাইরাস-মস্তিস্কসম্পন্ন ইত্যাদি) metanarrative থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ফুকো মুক্তিবাদের (emancipation) বক্তব্যে বিশ্বাসই করতেন না, বরং প্রত্যেক emancipatory বক্তব্যকে এক ধরণের শৃঙ্খল থেকে আরেক ধরণের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হওয়ার আহবান মনে করতেন। রোরটি এগুলোকে ভাষার খেলা মনে করতেন (দেখুন Contingency, Irony, and Solidarity)। তার কাছে এগুলো এক শ্রেণীর শব্দমালার মোকাবেলায় আরেক শ্রেণীর শাব্দিক ব্যবহারের যুদ্ধ। সুতরাং এখানে আমভাবে অজ্ঞেয়বাদী ও নাস্তিক্যবাদীদেরে ‘মুক্তমনা’র দর্শনে টানা সঠিক নয় – সবাই মুক্তমনা-জাত সপ্তদশ/অষ্টাদশ শতাব্দীর এনলাইটনম্যান্টের চিন্তায় নেই, সেই মেটানেরেটিভ এখন মৃত। (তবে এক গোষ্ঠী যে এটাকে ধরে রাখতে চাইবে না, এমনটি তো হয়না)। এখন একদল মস্তিষ্কশুন্য, গোঁড়াপন্থি-নাস্তিক অপরের ধর্ম নিয়ে ক্যাট-ক্যাট, ঘ্যাঁট-ধ্যাঁটেই আবদ্ধ যারা বিশ্বের প্রচলিত ধর্মগুলোকে উড়িয়ে দিয়ে ধরায় মানব-স্বর্গ রচনা করার উদ্দেশ্যে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব/বিদ্বেষ ছাড়াচ্ছে। এইসব মিলিট্যান্ট কর্মকাণ্ডে সকল নাস্তিক ও অজ্ঞেয়বাদী জড়িত নন। আমাদের অনেক শিক্ষক, সহপাটি ছাত্র, কর্মজীবনে অনেক লোকের মধ্যে নাস্তিক ও অজ্ঞেয়বাদী দেখছি যাদের কাউকে মুক্তমনা প্রত্যয় ও কর্মে দেখিনি। সুতরাং ‘উগ্র-বঙ্গাল-গোঁড়া-নাস্তিকরা’ সকল অজ্ঞেয়বাদী ও নাস্তিককে এক ভাবা সঠিক নয়। সমাজে যতটুকু সাম্প্রদায়িক সু-সম্পর্ক রয়েছে বঙ্গাল গোঁড়ারা সেই অবশিষ্ট শান্তিটুকু নস্যাৎ করতে ধর্ম বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। এরা নাস্তিক মৌলবাদী।
‘মুক্তমনা’ বলে, “মুক্তমনাদের আস্থা তাই বিশ্বাসে নয়, বরং যুক্তিতে”, তাহলে ‘খোদা-নাই, বা আছেন’ এটা বিশ্বাস না যুক্তি? এই প্রশ্ন নিরসন না করে প্রবক্তা যখন ‘মুক্তমনাদের আস্থা তাই বিশ্বাসে নয়, বরং যুক্তিতে’ তখন সে কী বলছে তা বুঝে বলছে, না নির্বোধের মত বলছে, সেটাই হয়ে পড়ে মূল প্রশ্ন।**লেখাটির দ্বিতীয় অংশ পড়ুন এখানে
সাইটটি/লেখাটি ভাল লাগলে অন্যদের মাঝে শেয়ার করুন।
_____________________
[১] মুক্তমনা এডমিন, (২০০৮) মুক্তমনা কী? মুক্তমনা [অনলাইন] http://mukto-mona.com/bangla_blog/?page_id=519[Accessed 10 Oct 2012]
2 comments:
ঠিক আছে, আমি শেষের অংশের acknowledgement লক্ষ্য করিনি, তাই আগের মন্তব্য উঠিয়ে নেবেন। ধন্যবাদ।
আসসলামু আলাইকুম! মুহতারাম, এইখানে যে আপনার এভাবে আগমণ ঘটবে এটা কল্পনাও করতে পারিনি। জাঝাকাল্লাহ।
আর দয়া করে যদি আমাদের এই ব্লগে আপনার কিছু লেখা দিতেন তবে খুবই ভাল হতো।
আর আপনার অনুমতি ব্যাতিরেকে উপরের লেখাটা নেওয়ার জন্য আন্তরিক দুঃখিত।
ধন্যবাদ।
Post a Comment